পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় GVAS) ৩ অক্টোবর ১৯২৪ হারুন-মারু জাহাজ এখনাে সূর্য ওঠে নি। আলোকের অবতরণিক পূর্ব-আকাশে। জল স্থির হয়ে আছে সিংহবাহিনীর পায়ের তলাকার সিংহের মতো। সূর্যোদয়ের এই আগমনীর মধ্যে মজে গিয়ে আমার মুখে হঠাৎ ছন্দো-গাথা এই কথাটা আপনিই ভেসে উঠল : হে ধরণী, কেন প্রতিদিন তৃপ্তিহীন একই লিপি পড়বারে বারে । বুঝতে পারলুম, আমার কোনো একটি আগন্তুক কবিতা মনের মধ্যে এসে পৌছবার আগেই তার ধুয়োটা এসে পৌচেছে। এইরকমের ধুয়ো অনেক সময়ে উড়ো বীজের মতো মনে এসে পড়ে, কিন্তু সব সময়ে তাকে এমন স্পষ্ট করে দেখতে পাওয়া যায় না । সমুদ্রের দূরতীরে যে-ধরণী আপনার নানা-রঙ আঁচলখনি বিছিয়ে দিয়ে পুবের দিকে মুখ করে একলা বসে আছে, ছবির মতো দেখতে পেলুম তার কোলের উপর একখানি চিঠি পড়ল। খসে কোন উপরের থেকে । সেই চিঠিখনি বুকের কাছে তুলে ধরে সে একমনে পড়তে বসে গেল ; তাল-তামালের নিবিড় বনচ্ছায়া পিছনে রইল এলিয়ে, নুয়ে-পড়া মাথার থেকে ছড়িয়ে পড়া এলোচুল । আমার কবিতার ধুয়াে বলছে, প্রতিদিন সেই একই চিঠি, সেই একখানির বেশি আর দরকার নেই ; সে-ই ওর যথেষ্ট । সে এত বড়ো, তাই সে এত সরল । সেই একখানিতেই সব-আকাশ এমন সহজে ভরে গেছে । ধরণী পাঠ করছে কত যুগ থেকে । সেই পাঠ-করাটা আমি মনে মনে চেয়ে দেখছি। সুরলোকের বাণী, পৃথিবীর বুকের ভিতর দিয়ে কণ্ঠের ভিতর দিয়ে রূপে রূপে বিচিত্র হয়ে উঠল। বনে বনে হল গাছ, ফুলে ফুলে হল গন্ধ, প্ৰাণে প্ৰাণে হল নিঃশ্বসিত, একটি চিঠির সেই একটিমাত্ৰ কথা— সেই আলো, সেই সুন্দর, সেই ভীষণ ; সেই হাসির ঝিলিকে ঝিকিমিকি, সেই কান্নার কাপনে ছলছল । এই চিঠি-পড়াটাই সৃষ্টির স্রোত— যে দিচ্ছে আর যে পাচ্ছে, সেই দুজনের কথা এতে মিলেছে, সেই মিলনেই রূপের ঢেউ । সেই মিলনের জায়গাটা হচ্ছে বিচ্ছেদ। কেননা দূর-নিকটের ভেদ না ঘটলে স্রোত বয় না, চিঠি চলে না। সৃষ্টি উৎসের মুখে কী একটা কাণ্ড আছে, সে এক ধারাকে দুই ধারায় ভাগ করে। বীজ ছিল নিতান্ত এক, তাকে দ্বিধা করে দিয়ে দুখানি কচি পাতা বেরল, তখনি সেই বীজ পেল তার বাণী, নইলে সে বােবা, নইলে সে কৃপণ, আপন ঐশ্বৰ্য আপনি ভোগ করতে জানে না। জীব ছিল একা, বিদীর্ণ হয়ে স্ত্রী-পুরুষে সে দুই হয়ে গেল। তখন তার সেই বিভাগের ফাকের মধ্যে বসল। তার ডাক-বিভাগ। ডাকের পর ডাক, তার অন্ত নেই। বিচ্ছেদের এই ফাক একটা বড়ো সম্পদ, এ নইলে সব চুপ সব বন্ধ। এই ফাৰ্কটার বুকের ভিতর দিয়ে একটা অপেক্ষার ব্যথা একটা আকাঙক্ষার টান টুনটন করে উঠল, দিতে-চাওয়ার আর পেতে-চাওয়ার উত্তর-প্রত্যুত্তর এপারে-ওপারে চালাচালি হতে লাগল। এতেই দুলে উঠল সৃষ্টিতরঙ্গ, বিচলিত হল ঋতুপর্যায় ; কখনাে বা গ্ৰীষ্মের তপস্যা, কখনাে বর্ষার প্লাবন, কখনাে বা শীতের সংকোচ, কখনাে বা বসন্তের দাক্ষিণ্য। একে যদি মায়া বল তো দােষ নেই, কেননা এই চিঠি লিখনের অক্ষরে আবছায়া, ভাষায় ইশারা- এর আবির্ভাব-তিরোভাবের পুরো মানে সব সময়ে বােঝা যায় না। যাকে চােখে দেখা যায় না, সেই উত্তাপ কখন আকাশ-পথ থেকে মাটির আড়ালে চলে যায় ; মনে ভাবি একেবারেই গেল বুঝি | কিছুকাল যায়, একদিন দেখি মাটির পর্দা ফাক করে দিয়ে একটি অন্ধুর উপরের দিকে কোন এক