পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዔ 88 রবীন্দ্র-রচনাবলী উপলক্ষে কতদিন আশ্রমের সংলগ্ন গ্ৰামপথে পদচারণ করতে করতে তিনি আমার সঙ্গে আলোচনাকালে যে-সকল দুরূহ তত্ত্বের গ্রন্থিমোচন করতেন। আজও তা মনে করে বিস্মিত হই । এমন সময়ে লর্ড কর্জন বঙ্গব্যবচ্ছেদ-ব্যাপারে দৃঢ়সংকল্প হলেন । এই উপলক্ষে রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে প্রথম হিন্দু-মুসলমান-বিচ্ছেদের রক্তবর্ণ রেখাপাত হল। এই বিচ্ছেদ ক্রমশ আমাদের ভাষা সাহিত্য আমাদের সংস্কৃতিকে খণ্ডিত করবে, সমস্ত বাঙালিজাতকে কৃশ করে দেবে এই আশঙ্কা দেশকে প্রবল উদবেগে আলোড়িত করে দিল । বৈধ আন্দোলনের পন্থায় ফল দেখা গেল না। লর্ড মরলি বললেন, যা স্থির হয়ে গেছে তাকে অস্থির করা চলবে না। সেই সময়ে দেশব্যাপী চিত্তমথনে যে আবর্ত আলোড়িত হয়ে উঠল তারই মধ্যে একদিন দেখলুম। এই সন্ন্যাসী বঁপ দিয়ে পড়লেন। স্বয়ং বের করলেন ‘সন্ধ্যা’ কাগজ, তীব্র ভাষায় যে মন্দির রস ঢালতে লাগলেন তাতে সমস্ত দেশের রক্তে অগ্নিজ্বালা বইয়ে দিলে। এই কাগজেই প্রথমে দেখা গেল বাংলাদেশে আভাসে ইঙ্গিতে বিভীষিকাপস্থার সূচনা। বৈদান্তিক সন্ন্যাসীর এতবড়ো প্ৰচণ্ড পরিবর্তন আমার কল্পনার অতীত ছিল । এই সময়ে দীর্ঘকাল তীর সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয় নি। মনে করেছিলুম হয়তো আমার সঙ্গে তার রাষ্ট্র-আন্দোলন প্রণালীর প্রভেদ অনুভব করে আমার প্রতি তিনি বিমুখ হয়েছিলেন অবজ্ঞাবশতই । Jr. নানা দিকে নানা উৎপাতের উপসর্গ দেখা দিতে লাগিল । সেই অন্ধ উন্মত্ততার দিনে একদিন যখন জোড়াসাকোয় তেতালার ঘরে একলা বসে ছিলেম হঠাৎ এলেন উপাধ্যায় । কথাবার্তার মধ্যে আমাদের সেই পূর্বকালের আলোচনার প্রসঙ্গও কিছু উঠেছিল। আলাপের শেষে তিনি বিদায় নিয়ে উঠলেন । চৌকাঠ পর্যন্ত গিয়ে একবার মুখ ফিরিয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, “রবিবাবু, আমার খুব পতন হয়েছে।” এই বলেই আর অপেক্ষা করলেন না, গেলেন চলে। স্পষ্ট বুঝতে পারলুম, এই মর্মান্তিক কথাটি বলবার জন্যেই তার আসা। তখন কর্মজাল জড়িয়ে ধরেছে, নিস্কৃতির উপায় ছিল না। এই তার সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা । উপন্যাসের আরম্ভে এই ঘটনাটি উল্লেখযোগ্য । চার অধ্যায়, বিশেষত উহার “আভাস” বা ভূমিকা সাময়িক পত্রে তীব্রভাবে সমালোচিত হয়। এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ১৩৪২ সালের বৈশাখের প্রবাসীতে যে প্রত্যুত্তর প্রকাশ করেন, এস্থলে তাহা মুদ্রিত হইল : চার অধ্যায় সম্বন্ধে কৈফিয়ত আমার চার অধ্যায় গল্পটি সম্বন্ধে যত তর্ক ও আলোচনা উঠেছে তার অধিকাংশই সাহিত্যবিচারের বাইরে পড়ে গেছে। এটা স্বাভাবিক, কারণ, এই গল্পের যে ভূমিকা, সেটা রাষ্ট্রচেষ্টা-আলোড়িত বর্তমান বাংলাদেশের আবেগের বর্ণে উজ্জ্বল করে রঞ্জিত | আমরা কেবল যে তার অত্যন্ত বেশি কাছে আছি তা নয়। তার তাপ আমাদের মনে সর্বদাই বিকীরিত হচ্ছে। এইজনেই গল্পের চেয়ে গল্পের ভূমিকাঁটাই অনেক পাঠকের কাছে মুখ্যভাবে প্রতিভাত । এই অধুনাতন কালের চিত্ত-আন্দােলন দূর অতীতে সরে গিয়ে যখন ইতিহাসের উত্তাপবিহীন আলোচ্য বিষয়মাত্রে পরিণত হবে তখন পাঠকের কল্পনা গল্পটিকে অনাসক্তভাবে গ্ৰহণ করতে বাধা পাবে না। এই আশা করি । অর্থাৎ তখন এর সাহিত্যরূপ স্পষ্ট হতে পারবে । ', এই রচনা সম্বন্ধে লেখকের তরফ থেকে আমার যা বক্তব্য সেটা বলে রাখি । বইটা লেখবার সময় আমি কী লিখতে বসেছিলুম সেটা আমার জানা সুতরাং এই ব্যক্তিগত খবরটা - আমিই দিতে পারি ; সেটা কী হয়ে উঠেছে সে কথা পাঠক ও সমালোচক আপনি বুদ্ধি ও