পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (সপ্তম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

গ্রন্থপরিচয় । 8 Q আলোচনা হতে থাকবে নানা ছাচের ও নানা মূল্যের, কালের উপর নির্ভর করে উদাসীন থাকাই লেখকের কর্তব্য । মূল্যের করে সে-সম্বন্ধে যেটাকে এই বইয়ের একমাত্র আখ্যানবস্তু বলা যেতে পারে সেটা এলা ও অতীন্দ্রের ভালোবাসা । নরনারীর ভালোবাসার গতি ও প্রকৃতি কেবল যে নায়ক নায়িকার চরিত্রের বিশেষত্বের উপর নির্ভর করে তা নয়, চারি দিকের অবস্থার ঘাতপ্ৰতিঘাতের উপরেও । নদী আপন নিঝরপ্ৰকৃতিকে নিয়ে আসে আপন জন্মশিখর থেকে, কিন্তু সে আপন বিশেষরূপ নেয় তটভূমির প্রকৃতি থেকে । ভালোবাসারও সেই দশা, এক দিকে আছে তার আন্তরিক সংরাগ, আর-এক দিকে তার বাহিরের সংবাধ । এই দুইয়ে মিলে তার সমগ্র চিত্রের বৈশিষ্ট্য। এলা ও অতীনের ভালোবাসার সেই বৈশিষ্ট্য এই গল্পে মূর্তিমান করতে চেয়েছি। তাদের স্বভাবের মূলধনটাও দেখাতে হয়েছে, সেইসঙ্গেই দেখাতে হয়েছে যে-অবস্থার সঙ্গে তাদের শেষ পর্যন্ত কারবার করতে হল। তারও বিবরণ | বাইরের এই অবস্থা যেটা আমাদের রাষ্ট্রপ্রচেষ্টার নানা সংঘট্টনে তৈরি, সেটার অনেকখানি অগত্যা আমার নিজের দৃষ্টিতে দেখা, ও তার কিছু কিছু আভাস আমার নিজের অভিজ্ঞতাকে সম্পর্শ করেছে । তার সংবেদন ভিন্ন লোকের কাছে ভিন্ন রকমের হওয়ারই কথা, তার সম্বন্ধে প্ৰত্যক্ষ অভিজ্ঞতারও পার্থক্য আছে । কিন্তু গল্পটাকে যদি সাহিত্যের বিষয় বলে মানতে হয় তা হলে এ নিয়ে তর্ক অনাবশ্যক, গল্পের ভূমিকারূপে আমার ভূমিকাকেই স্বীকার করে নিতে হবে । খৃস্টানও যদি কুমারসম্ভব পড়তে চায় তা হলে কালিদাসের বর্ণিত হরপার্বতীর আখ্যানকেই তার সত্য বলে মানা চাই, তা নিয়ে ধর্মতত্ত্বঘটিত তর্ক চলবে না । এই পৌরাণিক আখ্যানে সাংখ্যাতত্ত্ব বিশুদ্ধভাবে নিরূপিত হয়েছে কি না সে-প্রশ্ন উত্তর দেবার যোগ্যই নয়, আসল কথাটা এই যে, এই আখ্যানের ভূমিকায় হরপার্বতীর প্রেম ও মিলনটাই মুখ্যভাবে গোচর। এমন-কি, কুমারের জন্মবিবরণকেও কালিদাস উপেক্ষা করেছেন । যদি কোনো পাঠক বলেন আমার গল্পের ভূমিকা কোনো কোনো অংশে বা অনেক অংশে আমার স্বকপোলকল্পিত তা হলে গল্প-লিখিয়ে হিসাবে সে অভিযোগ মেনে নিলেও ক্ষতি হবে না । ইন্দ্রনাথ দ্বারা চালিত প্রচেষ্টার কী পরিণাম হল, কী হল বাঁটুর বা কানাইয়ের সে সংবাদটাকে কোনো স্থান দেওয়া হয় নি, উপসংহারে একমাত্র ব্যঞ্জনা অস্তু-এলার প্রেমের, এই উপসংহারের দ্বারা ঐ প্রেমের রূপটিকেই সম্পূর্ণতা দেওয়া হল । গল্পের উপক্ৰমণিকায় উপাধ্যায়ের কথাটা কেন এল এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই জিজ্ঞাস্য। অতীনের চরিত্রে দুটি ট্র্যাজেডি ঘটেছে, এক সে এলাকে পেলে না, আর সে নিজের স্বভাব থেকে ভ্ৰষ্ট হয়েছে। এই শেষোক্ত ব্যাপারটি স্বভাববিশেষে মনস্তত্ত্ব হিসাবে বাস্তব হতে পারে, তারই সাক্ষ্য উপস্থিত করার লোভ সংবরণ করতে পারি নি। ভয় ছিল পাছে কেউ ভাবে যে, এই সম্ভাবনাটি কবিজাতীয় বিশেষ মত বা মেজাজ দিয়ে গড়া। এর বাস্তবতা সম্বন্ধে অসন্দিগ্ধ হলে এর বেদনার তীব্ৰতা পাঠকের মনে প্রবল হতে পারে এই আশা করেছিলুম। তা হােক তবু গল্পের দিক থেকে এর কোনাে মূল্য নেই সে কথা মানি। গল্পের সাক্ষ্য গল্পের মধ্যে একজন মহিলা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছেন যে তার মতে ইন্দ্রনাথের চরিত্রে উপাধ্যায়ের জীবনের বহিরাংশ প্রকাশ পেয়েছে আর অতীন্দ্রের চরিত্রে ব্যক্ত হয়েছে তার অন্তরতর প্রকৃতি। এ কথাটি প্রণিধানযোগ্য সন্দেহ নেই । আর-একটা তর্ক আছে। গল্পের প্রসঙ্গে বিপ্লবচেষ্টাসংক্রান্ত মতামত পত্রিদের মুখে প্রকাশ পেয়েছে। কোনাে মতই যদি কোথাও না থাকত তা হলে গল্পের ভূমিকাটা হত নিরর্থক । ধরে নিতে হবে যারা বলছে, তাদেরই চরিত্রের সমর্থনের জন্যে এই সব মত। যদি কেউ