মাধব অসীম ঘৃণাভরে একট কঠোর দৃষ্টি নিক্ষেপ করিল, কিন্তু তাহাদের আগমন যেন সে লক্ষ্যই করে নাই এমন ভাবে পূর্ব্ববৎ পদচারণা করিতে লাগিল। সর্দ্দার ও ভিখু উভয়েই প্রদীপের কাছ ঘেঁষিয়া বসিল। ভিখু কটিদেশপ্রলম্বিত একটি ঝুলি হইতে সামান্য পরিমাণ গাঁজা ও অতি ক্ষুদ্র মস্তকবিহীন একটি কলিকা বাহির করিয়া গাঁজাটুকু বাঁ হাতের তালুতে রাখিয়া ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের প্রবল চাপ দিয়া তাহা টিপিতে লাগিল— গাঁজা কলিকায় সাজিবার পূর্ব্বে এইরূপ করিতে হয়। সর্দ্দার ততক্ষণে বাতিটা একটু উস্কাইয়া লইতে লইতে ব্যঙ্গ করিয়া বলিতে লাগিল, বাবু যে দেখছি আজ রাত্রে বড় ভাল মানুষটি!
পায়চারিরত মাধব একটু থামিয়া দুর্ব্বৃত্তের মুখের দিকে চাহিল; তাহার চেহারা দেখিয়া মনে হইল যেন সে কিছু একটা জবাব দিবে। কিন্তু সে তাহা না করিয়া সহসা পিছন ফিরিয়া পূর্ব্বের মত নিঃশব্দে পায়চারি করিতে লাগিল। ততক্ষণে গাঁজা প্রস্তুত হইয়াছে। কলিকাতে অগ্নিসংযোগ করিয়া দস্যু দুইজন তাহা টানিতে শুরু করিয়াছে। বন্দীর নীরব ঘৃণায় তাহারা যেন উত্ত্যক্ত হইয়া উঠিল। এতক্ষণ পর্য্যন্ত কোন অপমানসূচক কথাবার্ত্তা হইতে তাহারা বিরত ছিল। সাধারণত দেখা যায় যে, যে ব্যক্তি শ্রদ্ধার উদ্রেক করিতে পারে অতি নীচ হিতাহিত ー বিবেচনাশূন্য বর্ব্বর ও দূর হইতে তাহার সম্মান বজায় রাখিয়া চলে; তাহাদের মনে কেন জানি না, একটা ভয়মিশ্রিত শ্রদ্ধা জাগিয়া থাকে। পাঠকেরা লক্ষ্য করিয়াছেন, সর্দ্দার ঠিক সে শ্রেণীর বর্ব্বর ছিল না! তথাপি বন্দীর গর্ব্বিত দৃষ্টি ও কঠোর গাম্ভীর্য্য তাহাকে রসিকতার অবকাশ দেয় নাই। কিন্তু গঞ্জিকার ধূমে তাহার সংযম টলিয়া গেল।
ব্যঙ্গের হাসি হাসিয়া সে বলিয়া ফেলিল, বাবু, কল্কিতে দু-একটা টান দিয়ে দেখবেন? শপথ ক’রে বলছি গাঁজা যা সাজ হয়েছে, তাতে লাখোপতিও দুই-এক টান দিলে দোষ হবে না।