এই কথা বলিয়া মাতঙ্গিনী তাহার শয়ন-কক্ষের দ্বার খুলিতে অগ্রসর হইল, করুণা চলিয়া গেল। মাতঙ্গিনী দেখিল, দরজা তখনও অর্গলবদ্ধ। কয়েক ঘণ্টা পূর্ব্বে রাজমোহন যে কৌশলে দ্বারটি অর্গলমুক্ত করিয়াছিল, সেই কৌশল প্রয়োগ করিয়া দ্বার খুলিয়া মাতঙ্গিনী নিঃশব্দে কক্ষে প্রবেশ করিল। সে পুনরায় দরজা বন্ধ করিতে যাইবে, দেখিল তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আর একটি মূর্ত্তি ঘরে ঢুকিয়া ভারী হুড়কাটি লাগাইয়া দিল। পা ফেলার ধরনে ও শব্দে মাতঙ্গিনীর বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে, আগন্তুক তাহারই ভয়ঙ্কর পতিদেবতা।
রাজমোহন কোনও কথা কহিল না, নিঃশব্দে অন্ধকারে হাতড়াইয়া চক্মকি আর সোলা বাহির করিয়া আলো জ্বালিয়া যথাস্থানে সেটিকে রাখিল। তখনও সে নির্ব্বাক, তক্তপোশের এক ধারে বসিয়া সে হিংস্র দৃষ্টিতে মাতঙ্গিনীকে দেখিতে লাগিল। সেই দৃষ্টি দেখিয়া মাতঙ্গিনী বুঝিল তাহার ভাগ্যে কি আছে। সে বিবর্ণ বা ভয়কম্পিত না হইয়া সগর্ব্বে দৃঢ় ভাবে দাঁড়াইয়া রহিল—তাহার সমস্ত দেহে তেমনই প্রখর শ্রী ও সাহস ফুটিয়া উঠিল, যাহা দেখিয়া সেই দিনই সন্ধ্যায় তাহায় বর্ব্বর স্বামীর ক্রোধ অন্তর্হিত হইয়াছিল। বাহিরের ঝড়ের আর্ত্তনাদ, বারিপতনশব্দ ও ঊর্দ্ধাকাশের ক্রুদ্ধ মেঘের গর্জ্জন ক্ষণে ক্ষণে গৃহাভ্যন্তরের ভয়াবহ নীরবতা ভঙ্গ করিতেছিল।
পরিশেষে রাজমোহন কথা কহিল, হতভাগী—! তাহার কণ্ঠস্বর তীব্র হইলেও সচরাচর রুক্ষ মেজাজের দরুন তাহার কথায় যে রূঢ় কর্কশতা থাকে এখন তাহা মোটেই ছিল না। সে বলিল, হতভাগী, উপপতি করতে গিয়েছিলি?
মাতঙ্গিনী নিরুত্তর, রাজমোহন মেঝেতে পদাঘাত করিয়া চাপা অথচ ভীষণ গম্ভীর কণ্ঠে আবার বলিল, বল্ বলছি।
অর্দ্ধদোষী ও অর্দ্ধনির্দ্দোষী মাতঙ্গিনী উত্তর দিল, এসব কথার আমি কোনও জবাব দেব না।