তৎপূর্ব্ব চৈত্র মাসে কলিকাতা সহরে তাহার জন্ম হইয়াছিল। সেই শিশুপুত্রের রক্ষণাবেক্ষণ ও সংসারের সমুদয় কার্য্য নির্ব্বাহের ভার তাঁহার বালিকা পত্নীর উপরে পড়িয়া গেল। যিনি অপরের ক্লেশ একটু সহিতে পারিতেন না, সেই লাহিড়ী মহাশয় যে স্বীয় পত্নীর ক্লেশ দেখিয়া অস্থির হইয়া উঠিবেন, তাহাতে আশ্চর্য্য কি? তিনি জল বহা, কাঠ কাটা, বাজার করা প্রভৃতি ভূত্যের সমুদয় কাজ নিজেই নির্ব্বাহ করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাতে এক দিনের জন্য ক্লান্তি বোধ করিতেন না; অথবা লোকের প্রতি বিরক্তি বা বিদ্বেষ প্রকাশ করিতেন না। শ্রমের অন্ন মুখেই আহার করিতেন; এবং অহরহ স্বকর্ত্তব্য সাধনে মনোযোগী থাকিতেন। কিন্তু লোকের নির্য্যাতনের সমুদয় ভার বিশেষ ভাবে তাঁহার পত্নীর উপরেই পড়িত। পাড়ার অজ্ঞ স্ত্রীলোকদিগের অবজ্ঞাসূচক বাক্যে ও আত্মীয় স্বজনের আর্ত্তনদে তিনি অস্থির হইয়া উঠিতেন। তাঁহার মনস্তাপ দেখিয়া লাহিড়ী মহাশয় ক্ষুণ্নচিত্তে বাস করিতে লাগিলেন।
লাহিড়ী মহাশয় ঘরে বাহিরে যেন প্রজ্জ্বলিত অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে বাস করিতে লাগিলেন। ওদিকে কৃষ্ণনগরে এই উপবীত-ত্যাগের কথা প্রচারিত হইয়া সেখানেও মহা আন্দোলন উপস্থিত করিল। সেখানে সমাজের লোক রামতনু বাবুকে হাতের কাছে না পাইয়া তাহার বৃদ্ধ পিতা সাধু রামকৃষ্ণকে উত্যক্ত করিয়া তুলিল। বিনা অপরাধে তাঁহাকেও অনেক নির্য্যাতন সহ করিতে হইল। তাঁহার স্বভাব-নিহিত ধর্ম্মানুরাগবশতঃ তিনি উগ্রভাব ধারণ করিলেন না; পুত্রকে শাস্তি দিবার পরামর্শ করিলেন না; বা তাঁহার প্রতি বল-প্রয়োগের অভিসন্ধি করিলেন না; কিন্তু মরমে মরিয়া মৌনী হইয়া রহিলেন। বহুদিন পরে লাহিড়ী মহাশয় যখন আমাদের নিকট তাঁহার পিতার এই সময়কার ভাবের বর্ণনা করিতেন, তখন দর দর ধারে দুই চক্ষে জলধারা বহিত। বস্তুতঃ বলিতে কি আমরা তাহাতে একসঙ্গে পিতৃভক্তি ও নিজের বিশ্বাসানুসারে কার্য্য করিবার সাহস উভয় যে প্রকার সম্মিলিত দেখিয়াছি, তাহা জীবনে ভুলিবার নহে।
বৰ্দ্ধমানের আন্দোলন বশতঃই হউক অথবা শিক্ষাবিভাগের বন্দোবস্ত বশতঃই হউক এক বৎসরের অধিক কাল তিনি বৰ্দ্ধমানে থাকেন নাই। ১৮৫২ সালে তিনি বালি-উত্তরপাড়ার ইংরাজী স্কুলের হেড মাষ্টার হইয়া আসিলেন।
উত্তর পাড়াতে আসিয়া তাঁহার সামাজিক নির্ষ্যাতনের ক্লেশের কিঞ্চিৎ