পাতা:রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ.djvu/২৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২০০
রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ।

পারিত না। এই কারণে রামগোপাল ঘোষ প্রভৃতি ডিরোজিওর শিষ্যগণ ঘৃণাতে দেশীয় সংবাদপত্র স্পর্শও করিতেন না। কিন্তু অক্ষয়কুমার দত্ত সম্পাদিত তত্ত্ববোধিনী যখন দেখা দিল, তখন তাঁহারা পুলকিত হইয়া উঠিলেন। রামগোপাল ঘোষ একদিন লাহিড়ী মহাশয়কে বলিলেন—“রামতনু! রামতনু! বাঙ্গালা ভাষায় গম্ভীর ভাবের রচনা দেখেছ? এই দেখ,” বলিয়া তত্ত্ববোধিনী পাঠ করিতে দিলেন।

 ১৮৪৩ সাল হইতে ১৮৫৫ সাল পর্য্যন্ত অক্ষয় বাবু দক্ষতা সহকারে তত্ত্ববোধিনীর সম্পাদন কার্য্যে নিযুক্ত ছিলেন। ইতিমধ্যে অর্থোপার্জ্জনের কত উপায় তাহার হস্তের নিকট আসিয়াছে, তিনি তাঁহার প্রতি দৃকপাতও করেন নাই। এই কার্য্যে তিনি এমনি নিমগ্ন ছিলেন যে, এক এক দিন জ্ঞানালোচনাতে ও তত্ত্ববোধিনীর প্রবন্ধ লিখিতে সমস্ত রাত্রি অতিবাহিত হইয়া যাইত, তিনি তাহা অনুভবও করিতে পারিতেন না।

 এই কালের মধ্যে অক্ষয় বাবু আর একটী মহৎ কার্য্য সম্পাদন করিয়াছিলেন, যে জন্য তাঁহার নাম ব্রাহ্মসমাজের ইতিবৃত্তে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। ব্রাহ্মসমাজের ধর্ম্ম অগ্রে বেদান্তধর্ম্ম ছিল। ব্রাহ্মগণ বেদের অভ্রান্ততাতে বিশ্বাস করিতেন। অক্ষয়কুমার দত্ত মহাশয় এই উভয়ের প্রতিবাদ করিয়া বিচার উপস্থিত করেন। প্রধানতঃ তাঁহারই প্ররোচনাতে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর উভয় বিষয়ে গভীর চিন্তায় ও শাস্ত্রানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হন। তাঁহার প্রকৃতি অগ্রে বর্ণন করিয়াছি, তিনি সহজে স্বীয় অবলম্বিত কোনও মত বা কার্য্যপ্রণালী পরিবর্ত্তন করিতেন না। শীঘ্র কিছু অবলম্বন করিতেন না, করিলে শীঘ্র ছাড়িতেন না। আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে, ঈশ্বরালোকে, বহু পরীক্ষার পর কর্তব্য নির্ণয় করিতেন; এবং একবার যাহা নির্ণীত হইত তাহা হইতে সহজে বিচলিত হইতেন না। সুতরাং তাহাকে বেদান্তধর্ম্ম ও বেদের অভ্রান্ততা হইতে বিচলিত করিতে অক্ষয় বাবুকে বহু প্রয়াস পাইতে হইয়াছিল। ১৮৫০ সালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর মহাশয় বহু অনুসন্ধান ও চিন্তার পর অক্ষয় বাবুর অবলম্বিত মত যুক্তিসিদ্ধ জানিয়া, বেদান্তবাদ ও বেদের অভ্রান্ততা বাদ পরিত্যাগ করিলেন। তাঁহার সাহায্যে “ব্রাহ্মধর্ম্ম” নামক গ্রন্থ সংকলিত হইল; ইহা চিরদিন মহর্ষির ধর্ম্মজীবনের পরিণত ফল স্বরূপ বিদ্যমান রহিয়াছে। যে ১৮৫২ সালের কথা কহিতেছি, তখনও এই মহা পরিবর্ত্তন ব্রাহ্মসমাজকে ও সমগ্র বঙ্গদেশকে আন্দোলিত করিতেছে। তখনও দত্তজ মহাশয় স্বীয় মতের জয় দেখিয়া