পাতা:রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ.djvu/৩৪৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
২৮৪
রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ

অবলম্বন করিলেন। তাহা একদিকে বিদ্যাসাগরী বা অক্ষয়ী ভাষা ও অপরদিকে মালালী ভাষার মধ্যগ। ইহাতে অসন্তুষ্ট হইরা আমার পূজ্যপাদ মাতুল দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ মহাশয় তাহার সম্পাদিত সোমপ্রকাশে বঙ্কিমবাবু ও তাহার অনুকরণকারীদিগের নাম “শধ-পোড়া মড়াদাহের দল” রাখিলেন। অভিপ্রায় এই, যাহারা “শব” বলে তাহারা “দাহ” বলে, যাহারা “মড়া” বলে তাহারা তৎসঙ্গে “পোড়া” বলে, কেহই “শবপোড়া” বা “মড়াদাহ” বলে না। তাহার মতে বঙ্কিমী দল ঐরূপ ভাষা ব্যবহার দোষে দোষী। আমরা, সংস্কৃত কলেজের ছাত্রদল, সোমপ্রকাশের পক্ষাবলম্বন করিলাম এবং বঙ্কিমী দলকে “শব পোড়া মড়াদাহের দল বলিয়া বিদ্রুপ করিতে আরম্ভ করিলাম। বঙ্কিমের দল ছড়িবেন কেন? তাহার সোমপ্রকাশের ভাষাকে “ভট্টাচার্য্যের চানা” নাম দিয়া বিদ্রুপ করিতে লাগিলেন।

 ১৮৭২ সালে “বঙ্গদর্শন” প্রকাশিত হইল। বঙ্কিমের প্রতিভা আর এক আকারে দেখা দিল। প্রতিভা এমনি জিনিস, ইহা যাহা কিছু স্পর্শ করে তাহাকেই সজীব করে। বঙ্কিমের প্রতিভা সেইরূপ ছিল। তিনি মাসিক পত্রিকার সম্পাদক হইতে গিয়া এরূপ মাসিক পত্রিক স্বষ্টি করিলেন, যাহা প্রকাশ মাত্র বাঙ্গালির ঘরে ঘরে স্থান পাইল। তাহার সকলি যেন চিত্তকর্ষক, সকলি যেন মিষ্ট। বঙ্গদর্শন দেখিতে দেখিতে উদীয়মান স্বর্য্যের ন্যায় লোক চক্ষের সমক্ষে উঠিয়া গেল। বঙ্কিমচন্দ্র যখন বঙ্গদর্শনের সম্পাদক তখন তিনি রুসোর সাম্যভাবের পক্ষ, উদার নৈতিকের অগ্রগণ্য, এবং বেস্থাম ও মিলের হিতবাদের পক্ষপাতী। তিনি তাঁহার অমৃতময়ী ভাষাতে সাম্য নীতি এরূপ করিয়া ব্যাখ্যা করিতেন যে দেখিয়া যুবকদলের মন মুগ্ধ হইয়া যাইত। কিন্তু দুঃখের বিষয় বঙ্গদর্শন আহুদিন থাকিল না। বঙ্কিমবাবু বিষয়াস্তরে ব্যাপৃত হওয়াতে তাহা হস্তান্তরে গেল, ও সেই সঙ্গে তাহার আকর্ষণও গেল এবং ক্রমে তিরোভাব হইল।

 আমাদের দেশের প্রতিভাশালী ব্যক্তিদিগের সাধারণ নিয়মানুসারে বঙ্কিমের প্রতিভার শক্তি পন্থতাল্লিশ বৎসরের পর মন্দীভূত হইয়া আসিল। তৎপরে তিনি যে কয়েক খানি গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন, তাহার ভাষা ও চিত্রণশক্তির সেই পূৰ্ব্বকার উন্মাদিনী শক্তি নাই, সে সজীবতা নাই। তাহার দৃষ্টি ও সুখ হইতে পশ্চাৎদিকে পড়িতে লাগিল।

 শেষ কয় বৎসর তিনি ধৰ্ম্মতত্ত্বের ব্যাখ্যাতে আপনাকে অর্পণ করিয়াছিলেন।