সকলকে কহিলেন যে “যদি সংসারে কেহ ধার্ম্মিক থাকেন তবে তিনি এই ব্যক্তি।”
“তাঁহার গুণ বর্ণনায় শেষ হয় না। তাঁহার সাত আটটী পুৎত্র অকালে কালকবলিত হয়; তথাপি তাঁহার বদনে ক্ষণকালের নিমিত্ত কেহ কখনও শোকচিহ্ন দেখেন নাই। প্রত্যেক পুত্র বিয়োগ সময় তিনি স্থিরভাবে থাকিতেন এবং তাহার পর অধৈর্য্য পরিবারগণের শোকশান্তির নিমিত্ত বিশেষ চেষ্টা পাইতেন। যাঁহার কোমল হৃদয় চিরশত্রুর দুঃখে কাতর হইত, তাহার চিত্তকে যে জীবনাধিক পুত্র শোকেও বিচলিত করিতে পারিত না, এ সামান্য আশ্চর্য্যের বিষয় নয়।”
কি অপূর্ব্ব সাধুতা! এ বিবরণ শুনিলেও চিত্ত সমুন্নত হয়। এ স্থানে ইহাও উল্লেখ-যোগ্য যে দেওয়ান কার্ত্তিকেয়চন্দ্র রায়, যাঁহার আত্মজীবনচরিত হইতে এই সকল বিবরণ উদ্ধৃত করিতেছি, তিনিও সাধুতাতে একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তি ছিলেন। তাঁহার ন্যায় ধর্ম্মভীরু, কর্ত্তব্যপরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ ও পরোপকারী লোক আমরা অল্পই দেখিয়াছি। তাঁহার জ্যেষ্ঠতাতের অনেক গুণ তাঁহাতে বিদ্যমান ছিল। আত্মীয়-স্বজনের পোষণ, গুণিজনের উৎসাহদান, সাধুতার সমাদর, বিপন্নের বিপদুদ্ধার, এ সকল যেন তাহার স্বভাবসিদ্ধ ছিল। এই সকল গুণেই তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, অক্ষয়কুমার দত্ত, প্রভৃতি স্বদেশহিতৈষী স্বজাতিপ্রেমিক মহাজনগণের বিশেষ সন্মানিত হইয়াছিলেন। ইহার বিষয় বলিতে সুখ হয়, ভাবিলেও মন উন্নত হয়।
জগদ্ধাত্রী দেবী এইরূপ বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এরূপ গৃহে জন্মিলে ও বাড়িলে মানুষ যাহা হয় তিনি সেইরূপ ছিলেন। তাঁহার বিষয়ে অধিক কথা জানিতে পারি নাই। যাহা কিছু জানিয়াছি তাহাতে তিনি যে মনস্বিতা ও সাধুতা বিষয়ে একজন অগ্রগণ্য স্ত্রীলোক ছিলেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। জগদ্ধাত্রী পিতার একমাত্র কন্যা, তিন ভ্রাতার অগ্রজা, ও রূপলাবণ্যে এবং বিবিধ সদ্গুণে গৃহের শ্রী-স্বরূপা ছিলেন। শৈশবে রাজা শিবচন্দ্র তাঁহাকে কন্যার ন্যায় ভালবাসতেন। তাঁহাকে তাসের পোষাক পরাইয়া, নিজ হস্তীর উপরে হাওদাতে তুলিয়া, সঙ্গে লইয়া নগরভ্রমণ করিতেন। এই কন্যা পিতৃগৃহে কিরূপ আদরে ছিলেন সকলেই তাহা অনুমান করিতে পারেন। ধন সম্পদে, মান সম্ভ্রমে, তাঁহার পিতার সমকক্ষ লোক তখন কৃষ্ণনগরে ছিল না বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তিনি মনে করিলে সুখে সচ্ছন্দে চিরদিন পিতৃগৃহে বাস করিতে পারিতেন।