পাতা:রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ.djvu/৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটিকে বৈধকরণ করা হয়েছে। পাতাটিতে কোনো প্রকার ভুল পেলে তা ঠিক করুন বা জানান।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
৫৭

হরু ঠাকুর ও তাঁহার চেলা ভোলা ময়রা, নীলুঠাকুর, নিতাই বৈষ্ণর প্রভৃতি কবিওয়ালাগণ প্রসিদ্ধ হইয়াছিল। যে সময়ের কথা বলিতেছি তখনও সহরে অনেক বিখ্যাত কবিওয়ালা ছিল। ইহাদের লড়াই শুনিবার জন্য সহরের লোক ভাঙ্গিয়া পড়িত। কবিওয়ালাদিগের দলে এক একজন দ্রুতকবি থাকিত; তাহাদিগকে সুরকার বা বাঁধনদার বলিত। বাঁধনদারেরা উপস্থিত মত তখনি তখনি গান বাঁধিয়া দিত। বঙ্গের প্রসিদ্ধ কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত কিছুদিন কোনও কবির দলে বাঁধনদারের কাজ করিয়াছিলেন। দ্রুতকবিত্বের একটী দৃষ্টান্ত দেওয়া যাইতেছে। সে সময়ে আণ্টুনী ফিরিঙ্গী নামে একজন কবিওয়ালা ছিল। আণ্টুনী ফরাসডাঙ্গাবাসী একজন ফরাসিসের সন্তান; বাল্যকালে কুসঙ্গে পড়িয়া বহিয়া যায়; ক্রমে প্রতিভাবলে কবিওয়ালা হইয়া উঠে। আণ্টুনী নিজে একজন দ্রুতকবি ছিল। আণ্টুনী একবার গান বাধিল।

“ ও মা মাতঙ্গি, না জানি ভকতি স্তুতি জেতে আমি ফিরিঙ্গী।”

তৎপরক্ষণেই প্রতিদ্বন্দ্বীদলের দলপতি মাতঙ্গীর হইয়া উত্তর দিল;—

“যিশুখ্রীষ্ট ভজ গে যা তুই স্ত্রীরামপুরের গিজ্জেতে,
জাত ফিরিঙ্গী জাবড়জঙ্গী পারবনাক তরাতে। ইত্যাদি।

 এরূপ উত্তর প্রত্যুত্তর সব্বদাই হইত। হাপ আকড়াইগুলি অধিকাংশ স্থলে সখের দল ছিল। তাহাতে ভদ্রপরিবারের যুবকগণ দলবদ্ধ হইয়া নানা বাদ্যযন্ত্রসহ গান করিত।

 পাঁচালীর ব্যাপার অন্য প্রকার। ইহার কিঞ্চিৎ পরবর্ত্তী সময়ে তাহার বিশেষ প্রাদুর্ভাব হইয়াছিল। তাহাতে এক ব্যক্তি মূল-গায়ক স্বরূপ হইয়া সুর ও তান সহকারে, পদ্যে কোনও পৌরাণিক আখ্যায়িকা বর্ণন করিত ও মধ্যে মধ্যে সদলে সেই ভাবসূচক এক একটা গান করিত। ইহাও-লোকে অতিশয় পছন্দ করিত। লক্ষ্মীকান্ত বিশ্বাস, গঙ্গানারায়ণ নস্কর প্রভৃতি কয়েকজন পাঁচালীওয়ালা তৎকালে প্রসিদ্ধ হইয়াছিল। কিন্তু পাঁচালী গায়কদিগের মধ্যে দাশরথী রায়ের নামই সুপ্রসিদ্ধ। ইনি ১৮০৪ খ্রীষ্টাব্দে বর্দ্ধমান জেলাস্থ বাদমুড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দ-পর্জয়ন্ত জীবিত ছিলেন। দশরথী প্রথমে কোনও কবির-দলে বাঁধনদার ছিলেন। একবার বিরোধীদলের নিকট পরাস্ত হইয়া স্বীয় জননীর তাড়নার সে পথ পরিত্যাগ পূর্ব্বক পাঁচালী গানের পথ অবলম্বন করিয়াছিলেন। এই পাঁচালী এত অভদ্রতা ও অশ্লীলতা দোষে