পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নানাকথা ; পরাধীনতা ৩৪৭ মন্ত্রণ দান ও বিচারের ভার ব্রাহ্মণের হাতে ছিল ; এবং ব্রাহ্মণকে, যেমনই প্রবল রাজা হউন, ভয় করিতেন ও শ্রদ্ধা করিতেন। শাসন বিষয়ে ও বিচার বিষয়ে রাজার খেয়াল ততটা কাজ করিতে পারিত না । কিন্তু এই স্থলেই বোধ হয় প্রজার সহিত রাজার সম্বন্ধের শেষ। রাজা কর আদায় করিতেন, করের ভার দুৰ্ব্বহ। ছিল কিনা, সে বিষয়ে ইতিহাস কিছু বলে না। কর সংস্থাপনে রাজ ইচ্ছার উপর ও খেয়ালের উপর চলিতেন কি না, সে বিষয়েও ইতিহাস নিরুত্তর। রাজা যাহাই করুন, শাস্ত্রকার ব্রাহ্মণ কিন্তু এ বিষয়েও রাজার শক্তি সংযত করিয়া দিতে অন্ততঃ চেষ্টার ত্রুটি করিতেন না। রাজা কর আদায় করিতেন, তাহার দ্বারা আপন সেনা পোষণ করিতেন, শান্তিরক্ষা করিতেন, বাবুয়ানা করিতেন, এবং ইচ্ছা হইলে হয়ত সাধারণের হিতের জন্যও কতক খবচ করিয়া ফেলিতেন। কিন্তু প্রজার স্বাধীনতা সংহারের জন্য এক কপর্দক ব্যয় করিতেন, এরূপ প্রমাণ নাই । ব্যবস্থা প্রণয়ন অর্থাৎ আইন কান্তনেব প্রণয়ন রাজার হাতে ছিল না। প্রজা আপন চিরাগত প্রথানুসারে আপনার জীবনযাত্র। নিৰ্বাহ করিত। আইনের ব্যাখ্যাটা ব্রাহ্মণ ঠাকুরের হাতে ছিল বটে, এবং তিনি দায়ভাগ হইতে ডাক্তারী উপদেশ পৰ্য্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খরুপে দিতে ছাডিতেন না ; এবং অপরাধীর সংখ্য ক্রমে বাডাইয়৷ একবারে গণনার বাহির করিয়৷ তুলিয়াছিলেন। কিন্তু এই সকল অপরাধের অধিকাংশ স্থলেই স্বল্পত প্রায়শ্চিত্ত, জোর এক আধটু সামাজিক নিগ্রহের বিধান ছিল। রাজদ্বারে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খবর পন্থছিত ম| বিচারাদি কাৰ্য্যও অনেক স্থলে মধ্যস্থের দ্বারা ও সমাজের মুকবিবদের দ্বার সম্পাদিত হইত। গ্রামের ভিতর, পল্লীর ভিতর পুজার দৈনন্দিন ও নিত্যনৈমিত্তিক জীবন-ব্যাপার গ্রামের লোকের পরস্পর সাহায্যে সম্পাদিত হইত । রাজার সহিত কোন বিষয়ে কোন সম্বন্ধ ছিল না বা সংঘর্ষ ঘটিত না। ফলে শান্তিরক্ষা ও শক্রর সহিত লড়াই ভিন্ন অন্যান্য সমস্ত কাজই প্রজারা আপনা আপনি আপনাদের মধ্যেই গোছাইয়া লইত । গ্রামের পাচ জনে মিলিয়া গ্রামের কাজ সম্পাদন করিত। সমাজের পাঁচ জনে কৰ্ত্ত হইয়। সমাজের কাজ সম্পাদন করিত। রাজার নিকট উপস্থিত হইতে হইত না , রাজাও কোন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতেন না। অtভ্যন্তরীণ রাজনীতি রাজার অধিকারবহিভূত ছিল। হইতে পারে, এই সকল ব্যাপারে ব্রাহ্মণ অন্যান্য জাতির উপর অবৈধভাবে ও অন্যায্য উপায়ে ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি বিস্তারের চেষ্টা করিতেন, হয়ত এই সূত্রে ব্রাহ্মণের সঙ্গে অপরের বিরোধ ঘটিত বা বিদ্বেষ ঘটিত । কিন্তু সে বিরোধ প্রজায় প্রজায় ; রাজার সহিত তাহার কোন সম্পর্ক ছিল না। আর একটা প্রকাগু স্বাধীনতা ভারতের প্রজার স্বাভাবিক ছিল,— ভারতের বাহিরে অন্যত্র মনুষ যাহার রসাস্বাদে আজি পৰ্য্যন্ত বঞ্চিত রহিয়াছে। ভারতবর্ষে রাজ। কখনও প্রজার চিস্তার স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করেন নাই। ইউরোপে ইহার সম্পূর্ণ বিপরীত। সেখানে যাজকসম্প্রদায় জনসাধারণের জন্য ধর্মের ব্যাখ্যা করিয়া দিতেন। রাজা সেই যাজকসম্প্রদায়ের সহায় ও পৃষ্ঠপোষক থাকিতেন। যে ব্যক্তি প্রচলিত ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে রসনাস্ফালনে সাহসী হইত, সমগ্র রাজশক্তি বজ্রের মত তাহার মস্তকের উপর নিপতিত হইত।