পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নানাকথা : শিক্ষাপ্রণালী Vo শিক্ষার উদ্দেশু কি, শিক্ষা কাহাকে বলে, তাহার সম্বন্ধে বস্তৃত করিবার-সময় সকলেই প্রায় একরকম কথাই বলিয়া থাকেন, তবে প্রয়োগের সময় আর মূল সূত্রের অনুসারে কার্য্য হয় না। সৰ্ব্বাপেক্ষ আশ্চৰ্য্য এই যে, র্যাহারা বক্তৃতার সময় শিক্ষার সম্বন্ধে নানা যুক্তিপূর্ণ বাক্যমালা সাজাইয়া বলেন, তাহারাই আবার প্রয়োগের সময় ঠিক বিরোধী নীতি অবলম্বন করেন। আজকাল আমাদের শিক্ষা-বিভাগের বালকদের ডিসিপ্লিনের একটা ধুয়া উঠিয়াছে। বাজারের যেরূপ অবস্থা, তাহাতে বস্তুতঃই ডিসিপ্লিনের ব্যবস্থা একটু স্বচারু না থাকিলে জীবনযাত্রা অচল হয়। কিন্তু তথাপি ডিসিপ্লিন কথাটা শুনিলেই মনে কেমন একটা ব্যথা লাগে। সেনানিবাসে, পুলিশের থানায় . ও কারাগারে ডিসিপ্লিনের কঠিন বন্দোবস্তের দরকার বুঝিতে পারি ; কিন্তু আমাদের বিদ্যালয়গুলিও কি কালমাহাত্ম্যে ঐ সকল স্থানের সহিত এক পৰ্য্যায়ভুক্ত হইবার যোগ্য হইয়াছে ? কর্তৃপক্ষের এ ঘটনা যদি একটু চিন্তা করিয়া দেখেন, তাহ হইলে ভাল হয়। অন্যান্ত দেশে ব্যবস্থা কিরূপ জানিনা, কিন্তু আমাদের সেকালে চতুষ্পাঠীতে শাস্তি রক্ষার জন্য ও নীতি রক্ষার জন্য এইরূপ ব্যবস্থা প্রয়োগের কোন দরকার ছিল, বোধ হয় না । মঙ্গুসাহিতাতেও ব্রহ্মচারীর কঠোর সংযম অভ্যাসের বিধি আছে ; কিন্তু বিধির অপালনে দণ্ডবিধানের পারুন্য দেখি না । অথবা মনুসংহিতার মহিমান্বিত ব্রহ্মচর্য্যের কথা এ স্থলে উত্থাপন করিয়াই আমি কেন অকারণে পাতকগ্রস্ত হইতে বসিয়াছি ? শিক্ষার প্রণালী যেমনই হউক না কেন, আনন্দ ও আগ্রহ ও উৎসাহ যদি তাহার আনুষঙ্গিক না হয়, তবে তাহাকে যে শিক্ষা নাম দিতে চাহে, সে মুৰ্থ, সে পাষণ্ড, সে নাস্তিক। অভিধানে বাছিয়া আমি তাহার উপযুক্ত বিশেষণ সংগ্রহে অসমর্থ। আজকাল হিপ্লটজম্ বিদ্যার সমালোচনায় যে সকল নুতন তত্ত্ব আবিষ্কৃত হইতেছে, তাহাতে এই কথারই সমর্থন করে। মমুন্যের চিত্তের মত নমনীয় কোমল পদার্থ বুঝি আর কিছুই নাই। যখন এইরূপ অবস্থা, তখন শিক্ষার কোন পথ অবলম্বন করিতে হইবে, তাহ সহজেই অল্পমেয়। কেবল বেত্ৰাঘাত ও শাসন ও ভয় প্রদর্শন ও নৈরাপ্ত সঞ্চারের ব্যবস্থা করিয়া মানসিক উৎকর্ষ জন্মাইবার আশা কেবল বাতুলের স্বপ্ন মাত্র। পক্ষান্তরে স্নেহের বাণী ও আশার বাণী দুৰ্ব্বল হস্তেও বল প্রদানে সমর্থ হইতে পারে। স্পন্দহীন হৃৎপিণ্ডকে উত্তেজিত করিতে পারে, স্বায়ুর মধ্যে বৈদ্যুতিক প্রবাহ সঞ্চারিত করিয়া নিজীব দেহেও জীবনের সঞ্চার করিতে পারে। এ সকল স্কুল কথা ও সহজ কথা ; অথচ কেহ বুঝিবে না, হা হতোহস্মি ! হা দুগ্ধোহস্মি ! ব্যক্তিগত শিক্ষার সম্বন্ধে যে কথা বলা গেল, জাতীয় শিক্ষার সম্বন্ধেও সেই কথা আরও জোরের সহিত বলা যাইতে পারে। এবং আরম্ভ করিলে কথাও বোধ হয় ফুরাইবে না। প্রবন্ধান্তরে সে কথার আলোচনার চেষ্টা করিব । ( 'ভারতী’, জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৫ ) ।