নানাকথা : রাষ্ট্র ও নেশন \3 جويل আত্মপ্রসারে সর্বদাই উন্মুখ ; উহার প্রত্যেক অঙ্গ সাধারণ স্বার্থ রক্ষার জন্য একযোগে কাজ করে ; এক অঙ্গে আঘাত দিলে অদ্য অঙ্গ হইতে আৰ্ত্তধ্বনি উদগত হয় ; এবং সমগ্র শরীরের মঙ্গলের জন্য প্রত্যেক অঙ্গ আপনার সঙ্কীর্ণ মঙ্গল পরিহার করিতে কুষ্ঠিত হয় না। সমগ্র নেশনের শক্তিকে রাজশক্তি ও প্রজাশক্তি, এই দুই ভাগে বিভক্ত করিলে দেখা যায় নেশনের রাজশক্তির মূল প্রজাশক্তির ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ও প্রজাশক্তিকে অবলম্বন করিয়া দণ্ডায়মান । প্রজাশক্তি সৰ্ব্বদা ও সৰ্ব্বত্র রাজশক্তির মাহাত্ম্য অক্ষুণ্ণ রাখিতে যত্নপর। এবং যে প্রজাসজা লইয়া নেশনের শরীর, সেই প্রজাসজেঘর সর্বাঙ্গীন মঙ্গল সাধনার্থই রাজশক্তি বর্তমান। রাজশক্তি, অস্তিত্বের অন্য কোন উদ্বেত নাই। গজনীপতি মামুদ যখন সোমনাথ মহাদেবের মন্দির লুণ্ঠন কবেন, তখন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রাদেশিক হিন্দু সমাজের সকলে সেই অত্যাচারকাহিনীর সংবাদ রাখাও কৰ্ত্তব্য বোধ করে নাই। মহারাণ প্রতাপসিংহ যখন একাকী সিংহবিক্রমে দিল্লীশ্বরের সহিত যাবজ্জীবন সংগ্রাম করিয়াও আপনার উন্নত মস্তক অবনত করিতে স্বীকৃত হন নাই, ভিন্ন প্রদেশের ভারত সন্তানের শীতল শোণিত তখন উষ্ণ হয় নাই; মারাঠা সৈন্য যখন উত্তর কালে দিল্লীশ্বরের প্রজাগণের উপর অত্যাচার করিয়া বেড়াইত, তখন সেই প্রজাগণের স্বজাতিত্ব ও স্বধৰ্ম্মত্বের কথা মনেও স্থান দেয় নাই । তাহার অর্থ, ভারতবর্ষব্যাপী প্রকাণ্ড পুরাতন হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু হিন্দু নেশনের অস্তিত্ব ছিল না, হিন্দু সমাজের একাঙ্গের ব্যথা অপর অঙ্গ অনুভবে সমর্থ ছিল না। আবার চৌহানপতিকে আক্রান্ত ও বিপন্ন দেখিয়া রাঠোররাজ যখন হাস্য করিতেছিলেন, এবং মুসলমানহস্তে মগধ রাজ্য বিনষ্ট হইতে দেখিয়াও পার্শ্ববৰ্ত্তী বঙ্গরাজ যখন পলায়নের শুভ মুহূৰ্ত্ত নিরূপণার্থ পঞ্জিকা দেখিতেছিলেন, তখন ভারতবর্ষে খণ্ড রাষ্ট্র ছিল ও খণ্ড রাষ্ট্রমধ্যে কুলের ও কুলপতিগণের মৰ্য্যাদা ছিল, কিন্তু ভারতব্যাপী মহারাষ্ট্র ও মহারাষ্ট্রব্যাপী মহানেশন ছিল না। অতি প্রাচীন কালে এই সকল খণ্ড রাষ্ট্রে রাজশক্তি এক বংশ হইতে বংশান্তরে সংক্রান্ত হইত, এক কুল হইতে কুলাস্তরে সংক্রাস্ত হইত, প্রজাসঙ্ঘ উদাসীনের মত চাহিয়া দেখিত। শাসনদণ্ড মৌর্য্যের হস্ত হইতে স্খলিত হইয়া মিত্রের হস্তে, মিত্রের হস্ত হইতে স্বঙ্গের হস্তে, স্বঙ্গের হস্ত হইতে অন্ধের হস্তে সঞ্চালিত হইত, মৌর্য্য ও মিত্র ও স্বঙ্গ ও অন্ধের প্রজাপুঞ্জ তাহাতে স্বর্থ-দুঃখের কোন কারণ দেখিত না । উত্তরকালে হিন্দু রাজার হস্ত হইতে শাসনদণ্ড মুসলমানের হস্তে, মুসলমানের শাসন হইতে খ্ৰীষ্টানের হস্তে গিয়াছে ; কিন্তু ভারতবর্ষের প্রজাগণ এই সকল রাজবিপ্লবকে নৈসৰ্গিক বিপ্লবের ন্যায় অকাতর সহিষ্ণুতা সহকারে গ্রহণ করিয়াছে ; স্বয়ং এই বিপ্লব ঘটনার অনুকূলে বা প্রতিকূলে দাড়াইবার কৰ্ত্তব্যতা মনে স্থান দেন নাই । ইহার অর্থ-ভারতবর্ষে প্রজাশক্তি কখনও রাজশক্তির পশ্চাতে দাড়াইয়া উহাকে বলবতী করে নাই ; রাজশক্তি প্রজাশক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল না "ভারতবর্ষে কখনও নেশন ছিল না।
পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৩৬৩
অবয়ব