পাতা:রামেন্দ্রসুন্দর রচনাসমগ্র প্রথম খণ্ড.djvu/৪২৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নানাকথা : মহাকাব্যের লক্ষণ 836: তিনিও মহাকাব্য লেখেন নাই। গ্রীক কবির হেলেনকে আমরা চোখে দেখি নাই, র্তাহার গল্প শুনিয়াছি মাত্র ; কিন্তু যে রূপের আগুনে ট্রয় নগর ভস্মীভূত হইয়াছিল, তাহা আমাদের কল্পনার নেত্রকেও অদ্যাপি ঝলসিয়া দিতেছে। কিন্তু শেকৃস্পীয়বের নায়িকাগণের সৌন্দৰ্য্য বুঝিতে হইলে কেবল গল্প শুনিলে বা অনুবাদ পডিলে চলিবে না। তাহাদিগকে নিকটে গিয়া স্বচক্ষে দেখিবে ; সমজদারের চোখ লইয়া দেখিতে হইবে। শেক্সপীয়রের ভাষা, তাহার ছন্দ, তাহার ধ্বনি হইতে দূরে থাকিয় শেক্সপীয়রকে চিনিবার আশা করা যায় না। এক একবার মনে হয় বটে, শেকৃস্পীয়রের এক একখানা খণ্ড কাব্যের ভিতর হইতে যেন সাগরকল্লোলের অথবা ভূগর্ভতরঙ্গের মত শব্দ বাহিব হইয়া আসিতেছে যেন দাবদাহের গভীর শব্দ দূর হইতে কানে বাজিতেছে, কিন্তু নিকটে না গেলে সে শব্যের প্রকৃত পরিচয় পাওয়া যায় না । শেক্সপীয়ব হয়ত একালের মহাকবি, কিন্তু তিনি মহাকাব্য রচনা করেন নাই । কৃত্রিম পদার্থের সৌন্দর্য্যের সহিত স্বাভাবিক পৃদার্থের সৌন্দর্য্যের ঠিক তুলনা হয় না। কোন সৌন্দৰ্য্য বড়, তাহার তুলাদণ্ডে পরিমাপ চলে না। মনুষ্যপ্রতিভা সময়ে সময়ে যেন বিধাতার স্বষ্টিকেও পরাস্ত করে। সেই জন্য কৃত্রিমের পাশ্বে স্বাভাবিককে দাড করাইয়া কে ছোট, কে বড, নির্দেশ করিতে যাওয়া সমীচীন নহে। কৃত্রিমে যাহ। আছে, তাহা স্বাভাবিকে থাকে না ; আবার স্বাভাবিকে যাহ থাকে, তাহা কৃত্রিমে থাকে না। উভয় বস্তু ভিন্ন পৰ্য্যায়ের । মহাকাব্য চতুবাননের বদন হইতে বিনির্গত হয় নাই, উহা মনুষ্যেরই রচনা, সন্দেহ নাই ; কিন্তু উহাতে একটা স্বাভাবিকত্ব আছে, তাহ৷ সেই মন্তয্যের রচিত অন্য উৎকৃষ্ট বা উৎকৃষ্টতর কাব্যে নাই । তাহাতে বন জঙ্গল, প্রস্তর কঙ্কর থাকিলেও তাহার একটা গৌরব আছে, তাহাকে দূর হইতে চেন। যায় ; তাহার গল্প শুনিলে মন অভিভূত হয়, তাহাকে বুঝিতে হইলে সমজদার হইতে হয় না, শিক্ষানবিশী করিতে হয় না ; চশমা পরিতে হয় না ; স্বভাবদত্ত চক্ষু লইয়াই তাহাকে চিনিতে ও বুঝিতে পারা যায়। এই অলঙ্কারহীন, পরিচ্ছদহীন মুক্ত স্বাভাবিকতাই মহাকাব্যের বিশিষ্ট লক্ষণ । মতুষ্যের সভ্যতা, অন্তত বৰ্ত্তমান কালের সভ্যতা অত্যন্ত রুত্রিম বস্তু। এই কৃত্রিমতার আমি নিন্দা করিতেছি না ; হয়ত কৃত্রিমতাই মচুন্যত্বের প্রধান লক্ষণ ; হয়ত কৃত্রিমতা মন্তৰ্য্যত্ব হইতে অভিন্ন ; অন্তত মানবিকতার সহিত পাশবিকতার যাহা পার্থক্য, তাহারই নাম রুত্রিমতা । সুতরাং কৃত্রিমভার নিন্দা করিলে মনুষ্যের বিশিষ্ট ধৰ্ম্মকেই নিন্দ করা হয়। এই জন্য কৃত্রিমতার নিন্দ করিতে চাহি না। কৃত্রিমতাই মতুষ্যের গৌরব বলিলেও বিস্মিত হইব না। কৃত্রিমতাতেই মনুষ্যত্বের চরম স্মৃত্তি, তাহাও বলা যাইতে পারে। রুত্রিম সৌন্দর্য্যের স্বষ্টিতেই মানবপ্রতিভার পরাকাষ্ঠী, তাহাও স্বীকার করিতে প্রস্তুত আছি। কিন্তু তথাপি কৃত্রিম শিল্প কৃত্রিম। উহাতে চাকচিক্য আছে, গাথনি আছে, ওস্তাদি আছে ও সকলের উপরে উহার চেষ্টাকৃত নিৰ্ম্মাণ-কল্পনায়—উহার ডিজাইনে মমুষ্যের কৃষ্টিকর্তৃত্বের আভাস আছে ; আর যাহা স্বাভাবিক, তাহাতে চাকচিক্য নাই, গাথনি নাই, তাহা অযত্নকৃত অযথাবিন্যস্ত ঝটিকাভগ্ন বারিধারাবর্ষিত বৃহৎ দ্রব্যের সমাবেশে গঠিত। মানুষের বর্তমান কালের সভ্যতা অত্যন্ত কুত্রিম। সেই জন্য মহাকাব্যের প্রধান লক্ষণ ষে স্বাভাবিকতা, সেই স্বাভাবিকতার অভাবে বোধ হয় বর্তমান সভ্যতায়