পাতা:রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম - কান্তিচন্দ্র ঘোষ.pdf/১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

সমাজে আদৃত হয়েছেন, তার কারণ তাঁর এই জবাব। যাঁরা মুসলমান ধর্ম্মে বিশ্বাস করেন, তাঁদের কাছে এ মত শুধু অগ্রাহ্য নয়—একেবারে অসহ্য; কেননা এ কথা ধর্ম্ম মাত্রেরই মূলে কুঠারাঘাত করে। অপর পক্ষে এ বাণী মেনে নেবার জন্য এ যুগের ইউরোপের মন সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। ইউরোপের মন একান্ত বিজ্ঞান-চর্চ্চার ফলে, খ্রীষ্টধর্ম্মের উপর তার প্রাচীন বিশ্বাস হারিয়ে বসেছিল, কিন্তু তার পরিবর্ত্তে কোনও নূতন বিশ্বাস খুঁজে পায় নি। সুতরাং ওমারের কবিতায় বর্ত্তমান ইউরোপ তার নিজের মনের ছবিই দেখতে পেয়েছিল। এই হচ্ছে প্রথম কারণ, যার দরুণ ওমারের বাণী ইউরোপের মনকে এতটা চঞ্চল করে তুলেছিল।

 এস্থলে কেউ বলতে পারেন যে “Vanity of vanities—all is vanity” এসিয়ার এই প্রাচীন বাণী ত দু’হাজার বৎসর পূর্ব্বে ইউরোপের কানে পৌঁচেছিল। বাইবেলের একটা পুরো অধ্যায়ে (Ecclesiastes) ত ঐ কথাটারই বিস্তার করা হয়েছে, প্রচার করা হয়েছে; অতএব ওমারের বাণীর ভিতর কি এমন নূতনত্ব আছে যাতে করে সে বাণী ইউরোপের মনকে অনেকটা পেয়ে বসেছে?

 নূতনত্ব এই যে—ওমারের মতে, যে প্রশ্ন মানুষে চিরদিন করে আসছে, বিশ্ব কোন দিনই তার উত্তর দেয় না, কেননা দিতে পারে না। তাঁর চোখে এই সত্য ধরা পড়েছিল যে, এ বিশ্বের অন্তরে হৃদয় নেই, মন নেই, এ জগৎ অন্ধ নিয়তির অধীন, সুতরাং তার ভিতর-বাহির দুই সমান অর্থহীন, সমান মিছা। তিনি আবিষ্কার করেছেন যে—

ঊর্দ্ধে অধে, ভিতর বাহির, দেখ্‌ছো যা সব মিথ্যা ফাঁক,
ক্ষণিক এ সব ছায়ার বাজী, পুতুল-নাচের ব্যর্থ জাঁক।”

* * * *
সদ্য ফলের আশায় মোরা মরছি খেটে রাত্রিদিন,

মরণ পারের ভাবনা ভেবে আঁখির পাতা পলকহীন;
মৃত্যু-আঁধার মিনার হ’তে মুয়েজ্জিনের কণ্ঠ পাই—
মূর্খ তোরা, কাম্য তোদের হেথায় হোথায় কোথাও নাই।”

 অপরপক্ষে আমাদের দেশের রাজকবি ভর্ত্তৃহরির মত জেরুজিলামের রাজকবিরও মুখে “Vanity of vanities—all is vanity”, এ বাক্যের অর্থ “জগৎ মিথ্যা, ব্রহ্ম সত্য”। অর্থাৎ সংস্কৃত ও ইহুদি কবি দুইজনেই এই বিশ্বের অন্তরে এমন একটি সার সত্য, এমন একটি নিত্য বস্তুর সন্ধান পেয়েছিলেন, যেখানে মানুষের মন দাঁড়াবার স্থান পায়, এবং যার সাক্ষাৎকার লাভ করলে মানুষ চির শান্তি চির আনন্দ লাভ করে। ওমার খৈয়ামের মতে, ও হচ্ছে মানুষের মন-ভোলানো কথা—আসল সত্য এই যে, জগৎও মিথ্যা, ব্রহ্মও মিথ্যা। পূর্ব্বোক্ত রাজকবিরা মানুষের চোখের সুমুখে একটী অসীম আশার মূর্ত্তি খাড়া করেছিলেন, ওমার খৈয়াম করেছেন অনন্ত নৈরাশ্যের। ওমারের বাণী আমাদের মনকে জাগিয়ে তোলে, কেননা এ যুগে আমরা কেউ জোর করে বলতে পারি নে যে, আমরা সৃষ্টির গোড়ার কথা আর শেষ কথা জানিই জানি।


 এতক্ষণ ধরে ওমারের দর্শনের পরিচয় দিলুম এই কারণে যে, এই দর্শনের জমির উপরই তাঁর কবিতার ফুল ফুটে উঠেছে। যাঁদের মতে “জগৎ মিথ্যা ব্রহ্ম সত্য”, তাঁরা আমাদের উপদেশ দেন—

মায়াময়মিদং অখিলং হিত্বা
প্রবিশাশু ব্রহ্মপদং বিদিত্বা।”

 ওমারের মতে কিন্তু “মায়াময়মিদং অখিলং” হচ্ছে একমাত্র সত্য—অবশ্য সার সত্য নয়, অসার সত্য। তিনি তাই উপদেশ দিয়েছেন—