পাতা:রোবাইয়াৎ-ই-ওমর খৈয়াম - কান্তিচন্দ্র ঘোষ.pdf/১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

এক লহমা সময় আছে সর্ব্বনাশের মধ্যে তোর,
ভোগ-সায়রে ডুব দিয়ে কর্ একটা নিমেষ নেশায় ভোর।”

 বলা বাহুল্য ওমারের মুখে এ কথা হচ্ছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের বাণী। এ জীবনের যখন কোন অর্থ নেই, তখন যা ইন্দ্রিয়গোচর আর যা অনিত্য তাকেই বুকে টেনে নিয়ে আসা যাক, তাকেই উপভোগ করা যাক। ওমারের পূর্ব্বেও অনেকে মানুষকে এই উপদেশ দিয়েছেন কিন্তু তাঁদের কথার সঙ্গে ওমারের কথার অনেকটা প্রভেদ আছে। যাঁরা বলতেন “eat, drink and be merry, for to-morrow we die”, তাঁরা বিশ্ব-সমস্যার দিকে একেবারেই পিঠ ফিরিয়েছিলেন। আর প্রাচীন গ্রীসের Epicurean-র যা-কিছু ইন্দ্রিয়-গোচর তাকেই সন্তুষ্টচিত্তে গ্রাহ্য করে নিয়ে ইন্দ্রিয় সুখের চর্চ্চাটা একটি সুকুমার বিদ্যা করে তুলে নিয়েছিলেন। এস্থলে বলা আবশ্যক যে, তাঁরা ইন্দ্রিয় অর্থে বহিরিন্দ্রয় ও মানসেন্দ্রিয় দুই বুঝতেন। তাঁরা ছিলেন শান্তিতে, কিন্তু ওমারের হৃদয়-মন চির অশান্ত। ব্রহ্মজিজ্ঞাসা যে ব্যর্থ—এ সত্য ওমার সন্তুষ্ট মনে মেনে নিতে পারেন নি, এর বিরুদ্ধে তাঁর সকল মন বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। তাঁর কবিতার ভিতর দিয়ে বিশ্বের বিরুদ্ধে মানবাত্মার এই বিদ্রোহ, উপহাস ও বিদ্রূপের আকারে ফুটে বেরিয়েছে, কিন্তু তাঁর সকল হাসিঠাট্টার অন্তরে একটা প্রচ্ছন্ন কাতরতা আছে, এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব। ওমার খৈয়ামের কবিতা যে আমাদের এতটা মুগ্ধ করে তার প্রধান কারণ, তিনি দার্শনিক হলেও কবি, এবং চমৎকার কবি। দর্শন তাঁর হাতে জ্যামিতির প্রতিজ্ঞার আকার ধারণ করেনি, ফুলের মত ফুটে উঠেছে। এবং সে ফুল যেমন হাল্‌কা, যেমন ফুরফুরে, তেমনি সুন্দর, তেমনি রঙীন। এর প্রতিটি হচ্ছে ইরানদেশের গোলাপ,—এ গোলাপের রঙের সম্বন্ধে ওমার জিজ্ঞাসা করেছেন—

“কার্ দেওয়া সে লাল্‌চে আভা, হৃদয়-ছ্যাঁচা শোণিত-ছাপ”—

 উত্তর অবশ্য—ওমার! তোমার। অথচ এই রক্তে-নাওয়া গোলাপগুলির মুখে একটি সহাস্য don’t care ভাব আছে। আর তাদের বুকে আছে একাধারে অমৃত ও হলাহলের মিশ্রগন্ধ—এক কথায় মদিরগন্ধ। ওমারের কবিতার রস ফুলের আসব, সে রস পান করলে মানুষের মনে গোলাপী নেশা ধরে, সে অবস্থায় আমাদের মন থেকে ইহলোক পরলোক সকল লোকের ভাবনাচিন্তা আপনা হতে ঝরে পড়ে।

 শ্রীযুক্ত কান্তিচন্দ্র ঘোষ এই মন-মাতানো কাজ ভোলানো কবিতাগুলি বাঙলা করে বাঙালী পাঠক সমাজের হাতে ধরে দিচ্ছেন; আশা করি সেগুলি সকলের আদরের ও আনন্দের সামগ্রী হবে, কেননা এ অনুবাদের ভিতর যত্ন আছে, পরিশ্রম আছে, নৈপুণ্য আছে, প্রাণ আছে। ওমার খৈয়ামের এত স্বচ্ছন্দ ও স-লীল অনুবাদ আমি বাঙলা ভাষায় ইতিপূর্ব্বে কখনো দেখিনি।

শ্রীপ্রমথ নাথ চৌধুরী—