পাতা:লালন-গীতিকা.djvu/৩৫৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।
'অর্থ-সংকেত'

বাউলদের সাধনা মূলতঃ দেহ-কেন্দ্রিক, কিন্তু ভোগাত্মক দেহবাদ নহে। মানব-দেহকে তাহার মন্দির-রূপে কল্পনা করিয়াছেন। এই দেহ-মন্দিরের মধ্যেই দেবতা বাস করেন। সেই দেবতা মানুষের অন্তরতম সত্ত, অটল অধর আত্মা। দেহই অনন্ত আনন্দের আধার। পূর্ণানন্দরূপ চিৎ-সত্তা এই দেহে বিরাজমান। সেই আত্মাকে তাহার মানবরূপী কল্পনা করিয়া তাহাকে ‘মানুষ’, ‘মনের মানুষ’, ‘অধর মানুষ’, ‘রসের মানুষ’, ‘ভাবের মানুষ’, ‘সোনার মানুষ’ ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করিয়াছেন। সেই অন্তরতম সত্তার স্বরূপ উপলব্ধি ও তাহার সহিত আত্মবিস্মৃত চেতনাবিহীন একাত্মতা উপলব্ধি বাউলদের সাধনা। নিজের দেহের মধ্যেই যে সেই আত্মা বিরাজমান তাহা মানুষ উপলব্ধির অভাবে বুঝিতে পারে না, তাহাকে অন্যত্র সন্ধান করে, নিজেকে নিজেই চিনিতে পারে না। বাহিরে সন্ধান না করিয়া নিজের স্বরূপ উপলব্ধির কথাই লালন ফকির তাহার গানগুলিতে প্রকাশ করিয়াছেন।


১। দীন দুনিয়ার মধ্যে সেই আত্মার নাম অধর, তাহাকে সহজে উপলব্ধি করা যায় না। অটল-নিধিবরূপী অটল। মানুষের করণ—মনের মানুষের সন্ধান, উপলব্ধি। কর্তারূপ—দেহ-মধ্য-স্থিত আত্মার রূপ, সহজ-সাধক না হইলে পাওয়া যায় না, দিব্যজ্ঞানী হইলে নিজতত্ত্বে পাওয়া যায়। সিরাজ সাঁই—লালন ফকিরের গুরু। বাউলগণ গুরুবাদে বিশ্বাস করেন বলিয়া লালনের অনেক ভণিতায় সিরাজ সাঁই-এর নাম পাওয়া যায়।


| ২-৭। মানবদেহের মধ্যেই অন্তরতম আত্মা সেই ‘ মানুষ’ বিরাজমান। প্রতিভাসের মত দেখা গেলেও তাহাকে সহজে ধরা যায় না। তাহার অবস্থান অজানা স্থানে। দ্বি-দল অর্থাৎ আজ্ঞাচক্র তাহার প্রকাশের স্থান। তাহার অবস্থিতি এবং লীলার দল নিরূপিত হইলে সাধকের উপলব্ধি হয়। পূর্ণসত্তা দেহ-বিশেষে ‘অংশ কলা’ রূপে লীলা করিতেছেন। আসলে তিনি এক, বিভিন্ন বলিয়া প্রতীয়মান হন। যাহার মনের সন্দেহ মিটিয়াছে তিনিই উপলব্ধি করেন। নিজের স্বরূপ চিনিতে পারিলে অচেনাকে চিনিতে পারা যায়। বাহিরে দূর-দূরান্তে না সন্ধান করিয়া মনে নিষ্ঠা হইলে তাহাকে পাওয়া যাইবে। লখনা-লাক্ষণিক অর্থ। শব্দের তিনটি অর্থ, অভিধা, লক্ষণ ও ব্যঞ্জনা।২১