বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:লোকরহস্য-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.djvu/৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
সুবর্ণগোলক
৪৭

 কালীকান্ত আন্তরিক কাতরতার সহিত হাত যোড় করিয়া বলিতে লাগিল, “দোহাই বৌঠাকুরাণি, আপনার সাত দোহাই— আমাকে ছাড়িয়া দিন— আপনি আমার স্বভাব জানেন না—আমি সে চরিত্রের লোক নই।” কামসুন্দরী হাসিয়া বলিল, “তুমি যে চরিত্রের লোক, আমি বেশ জানি—এখন জল খাও।”

 কালীকান্ত বলিল, “যদি আপনার কাছে কেহ আমার এমন নিন্দা করিয়া থাকে, তবে সে ঠক—ঠকাম করিয়াছে। আপনার কাছে হাতযোড় করিতেছি, আপনি আমার গুরুজন—আমায় ছাড়িয়া দিন।”

 কামসুন্দরী রসিকতাপ্রিয়; মনে করিল যে, এ একতর নূতন রসিকতা রটে। বলিল, “প্রাণাধিক, তুমি কত রসিকতা শিখিয়া আসিয়াছ, তাহা বুঝা যাইবে।” এই বলিয়া স্বামীর দুই হস্ত ধারণ করিয়া আসনে বসাইবার জন্য টানিতে লাগিল।

 হস্তধারণ মাত্র কালীকান্ত সর্ব্বনাশ হইল মনে করিয়া “বাবা রে, গেলাম রে, এগো রে, আমায় মেরে ফেল্লে রে” বলিয়া চীৎকার আরম্ভ করিল। চীৎকার শুনিয়া গৃহস্থ সকলে ভীত হইয়া দৌড়িয়া আসিল। মা, ভগিনী, পিসী প্রভৃতিকে দেখিয়া কামসুন্দরী স্বামীর হস্ত ছাড়িয়া দিল। কালীকান্ত অবসর পাইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল।

 গৃহিণী কামসুন্দরীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কি লা কামি— জামাই অমন করে উঠলো কেন? তুই কি মেরেছিস্?”

 বিস্মিতা কামসুন্দরী মর্ম্মপীড়িতা হইয়া কহিল, “মারিব কেন? আমি মারিব কেন—আমার যেমন পোড়া কপাল।” ক্রমে ক্রমে সুর কাঁদনিতে চড়িতে লাগিল—“আমার যেমন পোড়া কপাল—কোন্ আবাগী আমার সর্ব্বনাশ করেছে—কে ওষুধ করেছে—” বলিতে বলিতে কামসুন্দরী কাঁদিয়া হাট লাগাইল।

 সকলেই বলিল, “হুঁ। তুই মেরেছিস্; নহিলে অমন করে কাতরাবে কেন?” এই বলিয়া সকলে, কামকে “পাপিষ্ঠা” “ডাইনী” “রাক্ষসী” ইত্যাদি কথায় ভর্ৎসনা করিতে লাগিল। কামসুন্দরী বিনাপরাধে নিন্দিতা ও ভর্ৎসিতা হইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে ঘরে গিয়া দ্বার দিয়া শুইয়া পড়িল।

 এদিকে কালীকান্ত বাহিরে আসিয়া দেখিল যে, বড় একটা গোলযোগ বাধিয়া উঠিয়াছে। নীলরতনবাবু স্বয়ং এবং দ্বারবান্ ও উদ্ধব, সকলে পড়িয়া যে যেখানে পাইতেছে, সে সেইখানে রামাকে প্রহার করিতেছে; কিল, লাতি, চড়, চাপড়ের বৃষ্টির মধ্যে রামা চাকর কেবল বলিতেছে, “ছেড়ে দে রে, বাবা রে, জামাই মারে, এমন কখন শুনি নাই,