পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (চতুর্থ সম্ভার).djvu/৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শরৎ-সাহিত্য-সংগ্ৰহ মন্দিরে ঢুকিয়া নিশেষে একধারে গিয়া বসিলাম, কেহ চাহিয়া দেখিল না। সকলের দৃষ্টিই রাধাকৃষ্ণের যুগলমূৰ্ত্তির প্রতি নিবন্ধ। মাঝখানে দাড়াইয়া কমললতা কীৰ্ত্তন করিতেছে—মদন-গোপাল, জয়-জয় যশোদা-দুলাল কি, যশোদা-দুলাল জয় জয় নন্দদুলাল কি, নন্দদুলাল জয় জয় গিরিধারী-লাল কি, গিরিধারী-লাল জয় জয় গোবিনা-গোপাল কি ! এই সহজ ও সাধারণ গুটি কয়েক কথার আলোড়নে ভক্তের গভীর বক্ষঃস্থল মথিত করিয়া কি সুধা তরঙ্গিত হইয়া উঠে তাহা আমার পক্ষে উপলব্ধি করা কঠিন ; কিন্তু দেখিতে পাইলাম উপস্থিত কাহারও চক্ষুই শুষ্ক নয়। গায়িকার দুই চক্ষু প্লাবিত করিয়া দবদর ধীরে অশ্র ঝরিতেছে এবং ভাবের গুরুভাবে তাহার কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে যেন ভাঙিয়া পড়িল বলিয়া । এইসকল রসের রসিক আমি নই, কিন্তু আমারও মনের ভিতরটা হঠাৎ যেন কেমনধারা করিয়া উঠিল । বাবাজী দ্বারিকাদাস মুদ্রিতনেত্রে একটা দেয়ালে ঠেস দিয়া বসিয়াছিলেন, তিনি সচেতন কি অচেতন বুঝা গেল না এবং শুধু কেবল ক্ষণকাল পূৰ্ব্বেই স্নিগ্ধ হাস্যপরিহাস-চঞ্চল কমললতাই নয়, সাধারণ গৃহকৰ্ম্মে নিযুক্ত যেসকল বৈষ্ণবীদের এইমাত্র সামান্ত তুচ্ছ-কুরূপ মনে হইয়াছিল, তাহারাও যেন এই ধূপ ও ধূনায় ধূমাচ্ছন্ন গৃহের অমুজ্জল দ্বীপালোকে আমার চক্ষে মুহূৰ্ত্তকালের জন্য অপরূপ হইয়া উঠিল । আমারও যেন মনে হইতে লাগিল, অদূরবর্তী ঐ পাথরের মূৰ্ত্তি সত্যই চোখ মেলিয়া চাহিয়া আছে এবং কান পাতিয়া কীৰ্ত্তনের সমস্ত মাধুর্য উপভোগ করিতেছে। ভাবের এই বিহবল মুগ্ধতাকে আমি অত্যন্ত ভয় করি, ব্যস্ত হইয়া বাহিরে চলিয়। আসিলাম—কেহ লক্ষ্যও করিল না । দেখি প্রাঙ্গণের একধারে বসিয়া গহর । কোথাকার একটা আলোর রেখা আসিয়া তাহার গায়ে পড়িয়াছে। অামার পদশব্দে তাহার ধ্যান ভাঙিল না, কিন্তু সেই একান্ত সমাহিত মুখের প্রতি চাহিয়া আমিও নড়িতে পারিলাম না, সেইখানে স্তব্ধ হইয়। রহিলাম। মনে হইতে লাগিল, শুধু আমাকেই একাকী ফেলিয়া রাখিয়া এ বাড়ির সকলেই যেন আর এক দেশে চলিয়া গিয়াছে—সেখানের পথ আমি চিনি না ! ঘরে আসিয়া আলো নিবাইয় গুইয়া পড়িলাম। নিশ্চয় জানি, জ্ঞান, বিদ্যা ও বৃদ্ধিতে আমি ইহাদের সকলের বড়, তথাপি কিসের ব্যথায় জানি না, মনের ভিতরট। কাদিতে লাগিল এবং তেমনি অজানা কারণে চোখের কোণ বাহিয়া বড় বড় ফোট গড়াইয়া পড়িল । কতক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম জানি না, কানে গেল, ওগো নতুনগোসাই ! জাগিয়া উঠিয়া বলিলাম, কে ? ፀል