শরৎ-সাহিত্য-সংগ্ৰহ সৌভাগ্য, আকাঙ্খা করিবার ভয়ঙ্কর আনন্দ হইতে চিরদিনের জন্য বঞ্চিত, যাহাদের জয়ের গর্ব, পরাজয়ের ব্যথা, কোনটাই জীবনে একটিবারও বহন করিতে হয় না, যাহাদের ভুল করিবার দুঃখ, আর ভুল না করিবার আত্মপ্রসাদ, কিছুরই বালাই নাই, যাহাদের প্রাচীন এবং বহুদর্শী বিজ্ঞ সমাজ সৰ্ব্বপ্রকারের হাঙ্গামা হইতে অত্যন্ত সাবধানে দেশের লোককে তফাং করিয়া, আজীবন কেবল ভালটি হইয়া থাকিবারই ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, তাই বিবাহ-ব্যাপারটা যাহাদের শুধু নিছক contract, তা সে যতই কেন না বৈদিক মন্ত্ৰ দিয়া document পাকা করা হোক, সে- দেশের লোকের সাধ্যই নাই, মৃত্যুঞ্জয়ের অন্ন-পাপের কারণ বোঝে। বিলাসীকে যাহারা পরিহাস করিয়াছিলেন, তাহারা সাধু গৃহস্থ এবং সাধৰী গৃহিণী—অক্ষয় সতীলোক তাহারা সবাই পাইবেন, তাও আমি জানি । কিন্তু সেই সাপুড়ের মেয়েটি যখন একটি পীড়িত শয্যাগত লোককে তিল তিল করিয়া জয় করিতেছিল, তাহার তখনকার সে গৌরবের কণামাত্রও হয়ত আজিও ইহাদের কেহ চোখে দেখেন নাই। মৃত্যুঞ্জয় হয়ত নিতান্তই একটা তুচ্ছ মানুষ ছিল, কিন্তু তাহার হৃদয় জয় করিয়া দখল করার জানন্দটাও তুচ্ছ নয়, সে সম্পদও অকিঞ্চিৎকর নহে। এই বস্তুটাই এ-দেশের লোকের পক্ষে বুঝিয়া ওঠা কঠিন । আমি ভূদেববাবুর “পারিবারিক প্রবন্ধে’রও দোষ দিব না এবং শাস্ত্রীয় তথা সামাজিক বিধি-ব্যবস্থার ও নিন্দ করিব না। করিলেও, মুখের উপর কড়া জবাব দিয়া যাহারা বলিবেন, এই হিন্দু-সমাজ তাহার নিতুল বিধি-ব্যবস্থার জোরেই অত শতাব্দীর অতগুলো বিপ্লবের মধ্যে যাচিয়া আছে, আমি তাহাদেরও অতিশয় ভক্তি করি, প্রত্যুত্তরে আমি কখনই বলিব না, টি-কিয়া থাকা চরম সার্থকতা নয়—এবং অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে, কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে। আমি শুধু এই বলিব যে, বড়লোকের নন্দগোপালটির মত দিবারাত্র চোখে-চোখে এবং কোলে-কালে রাখিলে যে সে বেশটি থাকিবে তাহাতে কোনই সন্দেহ নাই, কিন্তু একেবারে তেলাপোকাটির মত বাচাইয়া রাখার চেয়ে এক-আধবার কোল হইতে নামাইয়া আরও পাচজন মামুষের মত দু-এক পা হাটিত্তে দিলেও প্রায়শ্চিত্ত করার মত পাপ হয় না ।
পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (দশম সম্ভার).djvu/২৭৮
অবয়ব