পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (দ্বিতীয় সম্ভার).djvu/৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শ্রীকান্ত বটে। মার উকিল হওয়া উচিত ছিল। কারণ, যত প্রকারে কল্পনা করা যাইতে পারে, তিনি নিজেকে, মায় তার বংশধরটিকেও দায়িত্বে বাধিয়া গিয়াছেন। দলিলের কোথাও এতটুকু ক্রট রাখিয়া যান নাই। সে যাই হোক, গঙ্গাজল যে এই সুদীর্ঘ তেরো বৎসর কাল এই পাকা দলিলটির উপর বরাত দিয়াই নিশ্চিন্ত নিৰ্ভয়ে নীরবে বসিয়া ছিলেন, তাহা মনে হইল না ! বরঞ্চ মনে হইল, বহু চেষ্টা করিয়াও অর্থ ও লোকাভাবে স্থপত্রি যখন র্তাহার পক্ষে একেবারেই অপ্রাপ্য হইয়া উঠিয়াছে, এবং অনূঢ়া কন্যার শারীরিক উন্নতির প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া পুলকে বুকের রক্ত মগজে চড়িবার উপক্রম করিয়াছে, তখনই হতভাগ্য স্থপাত্রের উপর তাহার একমাত্র ব্রহ্মাস্ত্র নিক্ষেপ করিয়াছেন । মাতা বঁচিয়া থাকিলে এই চিঠির জন্য আজ তার মাথা খাইয়া ফেলিতাম। কিন্তু এখন যে উচুতে বসিয়া তিনি হাসিতেছেন, সেখানে লাফ দিয়াও যে তার পায়ের তলায় সজোরে একটা ঢু মারিয়া গায়ের জালা মিটাইব, সে-পথও বন্ধ হইয়া গিয়াছে। স্বতরাং মায়ের কিছু না করিতে পারিয়া, তার গঙ্গাজলের কি করিতে পারি ন৷ পারি, পরখ করিবার জন্য একদিন রাত্রে স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইলাম। সারারাত্রি ট্রেনে কাটাইয়া পরদিন তাহার পল্পীভবনে আসিয়া যখন পৌছিলাম, তখন বেলা অপরাহ্ল । গঙ্গাজল-মা প্রথমে আমাকে চিনিতে পারিলেন না । শেষে পরিচয় পাইয়া এই তেরো বৎসর পরে এমন কান্নাই কাদিলেন যে, মায়ের মৃত্যুকালে তার কোন আপনার লোকে চোখের উপর তাকে মরিতে দেখিয়াও এমন করিয়া কঁদিতে পারে নাই । বলিলেন, লোকত: ধৰ্ম্মতঃ তিনিই এখন আমার মাতৃস্থানীয়া এবং দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম সোপান-স্বরূপ আমার সাংসারিক অবস্থা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যালোচনা করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। বাবা কত রাখিয়া গিয়াছেন, মায়ের কি কি গহনা আছে, এবং তাহা কাহার কাছে আছে, আমি চাকরি করি না কেন, এবং করিলে কত টাকা আন্দাজ মাহিনা পাইতে পারি, ইত্যাদি ইত্যাদি। র্তাহার মুখ দেখিয়া মনে হইল, এই আলোচনার ফল র্তাহার কাছে তেমন সন্তোষজনক হইল না। বলিলেন, তার কোন-এক আত্মীয় বর্ষামুলুকে চাকরি করিয়া ‘লাল হইয়া গিয়াছে, অর্থাৎ অতিশয় ধনবান হইয়াছে। সেখানকার পথে-ঘাটে টাকা ছড়ানো আছে—শুধু কুড়াইয়া লইবার অপেক্ষামাত্র। সেখানে জাহাজ হইতে নামিতে না-নামিতে বাঙালীদের সাহেবের কাধে করিয়া তুলিয়া লইয়া গিয়া চাকরি দেয়—এইরূপ অনেক কাহিনী। পরে দেখিয়াছিলাম, এই ভ্রান্ত বিশ্বাস শুধু তাহার একার নহে, এমন অনেক লোকই এই মায়া-মরীচিকায় উন্মত্তপ্রায় হইয়া সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় সেখানে ছুটিয়া গিয়াছে, V)