পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (নবম সম্ভার).djvu/৩৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

নারীর মূল্য মঙ্গল-অমঙ্গলের ভিতর দিয়া চাহিয়া দেখিলে, পিতা, ভ্রাতা, স্বামীর সমস্ত হীনতা সমস্ত ফাকি একমুহূর্তেই স্বৰ্য্যের আলোর মত ফুটিয়া উঠে। একটু বুঝাইয় বলি। কোন একটা বিশেষ নিয়ম যখন দেশের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন তাহা যে একদিনেই হইয়া যায় তাহা নহে, ধীরে ধীরে সম্পন্ন হইতে থাকে। যাহারা সম্পন্ন করেন, র্তাহারা পুরুষের অধিকার লইয়া করেন। তখন র্তাহার পুরুষ—পিতা নন, ভ্রাতা নন, স্বামী নন। যাহাঁদের সম্বন্ধে নিয়ম করা হয়, র্তাহারাও আত্মীয়া নহে, নারীমাত্র। পুরুষ তখন পিতা হইয়া কন্যার দুঃখের কথা ভাবে না ; সে তখন পুরুষ হইয়া পুরুষের কল্যাণ চিন্তা করে—নারীর নিকট হইতে কতখানি কিভাবে আদায় করিয়া লইবে, সেই উপায় উদ্ভাবন করিতে থাকে। তার পর মমু আসেন, পরাশর আসেন, মোজেজ আসেন, পল আসেন, শ্লোক বঁধেন, শাস্ত্ৰ তৈয়ারী করেন—স্বার্থ তখন ধৰ্ম্ম হইয়া সুদৃঢ় হন্তে সমাজ শাসন করিবার অধিকার লাভ করে। দেশের পুরুষ-সমাজ, ব্যাসদেব, শাস্ত্রকারের গণেশ-ঠাকুর মাত্র। সকল দেশের শাস্ত্রই অনেকট এইভাবেই প্রস্তুত। তার পর শাস্ত্র মানিয়া চলিবার দিন আসে। ধৰ্ম্মের আসন জুড়িয়া বসিতে তাহার বিলম্ব ঘটে না, এবং সেই ধৰ্ম্ম-পালনের মুখে ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ স্নেহ-মমতা ভালো-মন্দ বন্যার তৃণের মত ভাসিয়া যায়। দেশের সহমরণেও তাহ দেখিয়াছি, অন্যান্য দেশের অধিকতর নিষ্ঠুর ব্যাপারের মধ্যেও তাহ দেখিয়াছি। ইহুদীরা ঠাকুরের সম্মুখে পুত্রকন্ত বলি দিতে কুষ্ঠিত হইত না । সন্তান-হত্যার কত নিষ্ঠুর ইতিহাস যে তাঁহাদের ধৰ্ম্ম-পুস্তকের পাতায় পাতায় লিপিবদ্ধ আছে তাহার সংখ্যা হয় না। তাহদের মলেক দেবতাটা ত শুধু এইজন্তই অমর হইয়া আছেন। মেক্সিকো-বাসী পিতা-মাতার তেজকাটুলিপোকা ঠাকুরের সম্মুখে তাহদের শ্রেষ্ঠ কন্যাটিকে হত্যা করিয়া পুণ্য অর্জন করিতে লেশমাত্র দ্বিধা করিত না । দাতা কর্ণের মত ধৰ্ম্মের নামে পুত্র হত্যা করিতে অনেক দেশে অনেক রাজাকেই দেখা যায়। মেবারের রাজা পুত্র বলি দিয়াছিল, কার্থেজের রাজা দেবতার সম্মুখে কষ্ঠ বধ করিয়াছিল। প্রাচীনদিনের বোধ করি এমন একটি দেশও বাকী নাই যেখানে ধৰ্ম্মের নামে সস্তান-হত্যা ঘটে নাই। তবে কি তখনকার দিনে পিতা-মাতার সম্ভানকে ভালবাসিত না ? বালিত নিশ্চয়ই, কিন্তু কোথায় ছিল তখন স্নেহ-মমতা ? থাকিতে পায় না। প্রথা যখন একবার ধৰ্ম্ম হইয়া দাড়ায়, দেবতা প্রসন্ন হন, পরকালের কাজ হয়, তখন কোন নিষ্ঠুরতাই আর অসাধ্য হয় মা। বরঞ্চ, কাজ যত নিষ্ঠুর, যত বীভৎস হয়, পুণ্যের ওজনও সেই পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। সস্তান বলিয়া পিতা-মাতা আর তখন মুখ ফিরাইয়া দাড়ায় না। ©¢ፃ