পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/১১৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শরৎ-সাহিত্য-সংগ্ৰহ এই সেদিন যাহারা দল বাধিয়া তাহার আশ্রয় চাহিতে আসিয়াছিল, আজ অক্ষম জানিয়া প্রবলের চোখের ইঙ্গিতে তাহারই বিরুদ্ধে তাহারা মন্ত্রণা করিতে একত্র হইয়াছে—সেদিনের সমস্ত সঙ্কল্প তাহাদের কোথায় ভাসিয়া গেল ! যে প্রবল, ষে ধনবান, যে ধৰ্ম্মজ্ঞান বিরহিত, তাহার অত্যাচার হইতে বাচিবার কোন পথ দুৰ্ব্বলের নাই । কোথাও ইহার নালিশ চলে না, ইহার বিচার করিবার কেহ নাই—ভগবান কান দেন না, সংসারে চিরদিন ইহা অবারিত চলিয়া আসিতেছে। এই যে আজ এতগুলি লোক গিয়া একটিমাত্র প্রবলের পদতলে তাহাদের বিবেক, ধৰ্ম্ম, মনুষ্যত্ব সমস্ত উজাড় করিয়া দিয়া কোনমতে বাচিয়া থাকিবার একটুখানি আশ্বাস লইয়া ঘরে ফিরিয়া আসিল, ইহার লজ্জা, ইহার দৈন্য, ইহার ব্যথা যত বড়ই হোক, যতদূর দেখা যায়, এই দুঃখীদের এই ক্ষুদ্র কৌশলটুকু ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই চোখে পড়ে না । যে অন্যায় এতগুলি মানুষকে এমন অমানুষ করিয়া দিল, তাহাকে প্রতিহত করিবার শক্তি এতবড় বিশ্ব-বিধানে কই ? এই যে সাগর সর্দার সেদিন পীড়িতের পক্ষ গ্রহণ করিয়াছিল, দুৰ্ব্বলের এতবড় স্পৰ্দ্ধার সহস্র গুণ বড় দণ্ড তাহার তোলা আছে—অব্যাহতির কোন পথ নাই। হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা সাগর, এ সব তুই শুনলি কার মুখে ? সাগর কহিল, স্বয়ং হুজুরের মুখে । তাহলে এ-সকল তারই মতলব ? সাগর চিন্তা করিয়া কহিল, কি জানি মা, কিন্তু মনে হয় রায়মশায়ও আছেন । ষোড়শী একমুহূৰ্ত্ত স্থির থাকিয়া বলিল, আচ্ছা সাগর, তুই বলতে পারিস, জমিদার আমার উপর অত্যাচার করেন না কেন ? আমি ত ভাঙা কুঁড়ের একলা থাকি, ইচ্ছে করলেই ত পারেন ? সাগর হাসিল, কহিল, কে তোমাকে বললে মা, তুমি একলা থাকো ? মা, আমাদের নিজের পরিচয় নিজে দিতে নেই, গুরুর নিষেধ আছে, বলিতে বলিতে সহসা তাহার বলিষ্ঠ দক্ষিণ হাতের পাঁচটা আঙ্গুল লাঠির গায়ে যেন ইস্পাতের সাড়াসির মত চাপিয়া বসিল, কহিল, যার ভয়ে চণ্ডীর মন্দিরে না বসে ষোল-আনা বসতে গেল আজ এককড়ির কাছারি-বাড়িতে, তারই ভয়ে কেউ তোমার ত্রিসীমানায় ঘেষে না । হরিহর সর্দারের ভাইপো সাগরের নাম দশ-বিশ ক্রোশের লোকে জানে, তোমার উপর অত্যাচার করবার মানুষ ত মা পঞ্চাশখানা গ্রামে কেউ খুঁজে পাবে না । যোড়শীর দুই চক্ষু অকস্মাং জলিয়া উঠিল, কহিল, সাগর, এ কি সত্য ? সাগর হেট হইয়া তৎক্ষণাৎ তাহার হাতের লাঠিটা ষোড়শীর পায়ের নীচে রাখিরা দিয়া কহিল, বেশ ত মা, সেই আশীৰ্ব্বাদই কর না, কথা যেন আমার মিথ্যে না হয়। > **