পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/১৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
দেনা-পাওনা

 এ যাইতেই হইবে, তবুও কহিল, আমার কাছে ত টাকা নেই সর্দার, হুজুরের কাছে আমাকে নিয়ে গিয়ে তোমাদের কি লাভ হবে?

 কিন্তু সর্দার বলিয়া যাহাকে ভিক্ষা জ়ানানো হইল, সে এই আবেদনের ধার দিয়াও গেল না। শুধু প্রত্যুত্তরে একটা বিশ্রী ভঙ্গী করিয়া বলিল, চল্‌ মাগী, চল্‌।

 আর ষোড়শী কথা কহিল না। এই লোকগুলা স্থানান্তর হইতে আসিয়াছে, তাহার মর্যাদার কোন ধারণাই ইহাদের নাই। সুতরাং টাকার জন্য, খাজনার জন্য নরনারী নির্বিচারে সামান্য প্রজার প্রতি যে আচরণে নিত্য অভ্যস্ত, এ ক্ষেত্রেও তাহাদের কোন ব্যতিক্রম হইবে না। অনুনয়-বিনয় নিষ্ফল কাঁদাকাটায় কেহ সাহায্য করিতে আসিবে না। অবাধ্য হইলে হয়ত পথের মধ্যেই টানাহেঁচড়া বাধাইয়া দিবে। প্রকাশ্য রাজপথে অপমানের এই চরম কদর্যতার চিত্র তাহাকে মুখ বাঁধিয়া যেন সুমুখের দিকে ঠেলিয়া দিল। পথে রাখাল বালকেরা গরু লইয়া ফিরিয়াছে, কৃষকেরা দিনের কর্ম শেষ করিয়া বোঝা মাথায় ঘরে চলিয়াছে—সবাই অবাক্‌ হইয়া চাহিয়া রহিল; ষোড়শী কাহারও প্রতি দৃষ্টিপাত করিল না, কাহাকেও কিছু বলিবার উদ্যম করিল না, কেবল মনে মনে কহিতে লাগিল, মা ধরিত্রী দ্বিধা হও!

 সূর্য অস্ত গেল, অন্ধকার অগ্রসর হইয়া আসিল। সে যন্ত্রচালিত পুতুলের মত নীরবে শান্তিকুঞ্জের গেটের মধ্যে প্রবেশ করিল; থামিবার আপত্তি করিবার কোথাও এতটুকু চেষ্টা পর্যন্ত করিল না।

 যে ঘরে আনিয়া তাহাকে হাজির করা হইল এটা সেই ঘর, এককড়ি যেখানে সেদিন প্রবেশ করিয়া ভয়ে রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়াছিল। তেমনি আবর্জনা, তেমনি মদের গন্ধ। সাদা, কালো, লম্বা, বেঁটে নানা আকারের শূন্য মদের বোতল চারিদিকে ছড়ানো। শিয়রের দেয়ালে খান-দুই চকচকে ভোজালি টাঙ্গানো, এককোণে একটা বন্দুক ঠেস দিয়ে রাখা, হাতের কাছে একটা ভাঙ্গা তেপায়ার উপর একজোড়া পিস্তল, অদূরে ঠিক সুমুখের বারান্দায় কি একটা বন্য পশুর কাঁচা চামড়া ছাদ হইতে ঝুলানো—তাহার বিকট দুর্গন্ধ মাঝে মাঝে নাকে লাগিতেছে। বোধ হয় খানিক পূর্বেই গুলি করিয়া একটা শিয়াল মারা হইয়াছে। সেটা তখন পর্যন্ত মেঝেয় পড়িয়া—তাহারই রক্ত গড়াইয়া কতকটা স্থান রাঙ্গা হইয়া আছে। জমিদার শয্যার উপর চিত হইয়া শুইয়া শুইয়া কি একখানা বই পড়িতেছিলেন। মাথার কাছে আর একটা মোটা বাঁধানো বইকে বাতিদান করিয়া মোমবাতি জ্বালানো হইয়াছে; সেই আলোকে চক্ষের পলকে অনেক বস্তুই ষোড়শীর চোখে পড়িল। বিছানায় বোধ করি কেবল চাদরের অভাবেই একটা বহুমূল্যের শাল পাতা, তাহার অনেকখানি মাটিতে লুটাইতেছে; দামী সোনার ঘড়িটার উপরে আধপোড়া একখণ্ড চুরুট হইতে তখনও ধূমের সূক্ষ্ম রেখাটা ঘুরিয়া ঘুরিয়া উপরে উঠিতেছে; খাটের নীচে একটা

১১