পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (পঞ্চম সম্ভার).djvu/৩২১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাল্য-স্মৃতি

মত। কচি খোকার মত কাঁদিয়া ফেলি না। বাস্তবিক, কাঁদিতে আমার লজ্জা বোধ হইত, এখনও হয়, কিন্তু সামলাইতে পারি না। লুকাইয়া কেহ কোথাও নাই দেখিয়া, চোরের চুরি করার মত—দুবার চক্ষু মুছিয়া ফেলি। স্কুলে পড়িতে যাই, একপাল লোক ভিক্ষা করিতেছে। কাহারও হাত নাই, পা নাই, কাহারও চক্ষু দুটি নাই, এমনই কত কি নাই ধরণের লোক দেখি, তাহা আর বলিতে পারি না। তিলক কাটিয়া খঞ্জনী হাতে লইয়া “জয় রাধে" বলিয়া ভিক্ষা করে, তাহাই জানি, এ-সব ভিখারী আবার কি রকমের? মনের দুঃখে মনে মনেই বলিতাম, ঠাকুর! এদের আমাদের দেশে পাঠিয়ে দাও। যাক পোড়া ভিখারীর কথা— আমার কথা বলি। চক্ষু অনেকটা সড়গড় হইলেও আমি একেবারে বিদ্যাসাগর হইতে পারিলাম না। মধ্যে মধ্যে আমাদের দেশের মা সরস্বতী যে কোথা হইতে আসিয়া আমার স্কন্ধদেশে ভর করিতেন, বলিতে পারি না। তাঁহার আজ্ঞাধীন হইয়া যে-সকল সৎকর্ম্ম করিয়া ফেলিতাম, তজ্জন্য এখনও আমার সে সরস্বতীর উপর ঘৃণা হইয়া আছে। বাসায় কাহার কি অনিষ্ট করিব, সর্ব্বদা খুঁজিয়া বেড়াইতাম। রামবাবু তিনঘণ্টা ধরিয়া তাঁহার দেশী কালাপেড়ে কাপড় কুঞ্চিত করিলেন; বিকালে বেড়াইতে যাইবেন। আমি অবসর বুঝিয়া কাপড়খানি খুলিয়া টানিয়া প্রায় সোজা করিয়া রাখিয়া দিলাম। তিনি বিকালে বস্ত্রখানির অবস্থা দেখিয়া বসিয়া পড়িলেন। আমার আর আমোদ ধরে না। জগন্নাথবাবুর অফিসের বেলা হইয়া গিয়াছে, তাড়াতাড়ি আহার করিতে বসিয়াছেন, একমুহূর্ত্ত বিলম্ব সহিতেছে না। আমি সময় বুঝিয়া তাঁহার চাপকানের বোতামগুলি সমস্ত কাটিয়া লইলাম। স্কুল যাইবার সময় একবার উঁকি মারিয়া দেখিয়া গেলাম, জগন্নাথবাবু ডাক ছাড়িয়া কাঁদিবার উপক্রম করিতেছেন। মনের আনন্দে আমি সমস্ত পথ হাসিতে হাসিতে চলিলাম। সন্ধ্যার সময় জগন্নাথবাবু অফিস হইতে ফিরিয়া বলিলেন, আমার চাপকানের বোতামগুলো গদা-বেটা চুরি করে বেচে ফেলেচে—বেটাকে তাড়িয়ে দাও। জগন্নাথবাবুর চাপকানের বিবরণে দাদা ও রামবাবু উভয়েই মুখ টিপিয়া হাসিলেন। সেজদাদা বলিলেন, কত রকমের চোর আছে, কিন্তু চাপকানের বোতাম চুরি করে বেচে ফেলতে কখনও শুনিনি। জগন্নাথবাবু এ-কথায় আরও ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, বেটা বোতামগুলো সকালে নিলে না, বিকালে নিলে না, রাত্রে নিলে না, ঠিক অফিস যাবার আগেই নিয়েচে। আজ দুৰ্গতির একশেষ করেচে, একটা কালো ছেড়া পিরান গায়ে দিয়ে আমার অফিস যেতে হয়েচে।

 সকলেই হাসিলেন। জগন্নাথবাবুও হাসিলেন। কিন্তু আমি হাসিতে পারিলাম না। মনে ভয় হইল, পাছে গদাধরকে তাড়াইয়া দেওয়া হয়। সে যে নির্ব্বোধ, হয়ত কোনও কথা বলিবে না, সমস্ত অপরাধ নিজের স্বন্ধে স্বেচ্ছায় তুলিয়া লইবে।

৩১৫