পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

শ্ৰীকান্ত ঠেলাঠেলি করিতেছে! কিন্তু এ-বাড়ির কোন ঘরে আবশ্যকীয় দ্রব্যের অতিরিক্ত একটা বস্তুও চোখে পড়িল না ; এবং যাহা চোখে পড়িল, সেগুলি যে গৃহস্বামিনীর আপনার প্রয়োজনেই আহৃত হইয়াছে, এবং তাহার নিজের ইচ্ছা এবং অভিরুচিকে অতিক্রম করিয়া আর কাহারও প্রলুব্ধ অভিলাষ যে অনধিকার প্রবেশ করিয়া জায়গা জুড়িয়া বসিয়া নাই, তাহা অতি সহজেই বুঝা গেল। আরও একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। একটা নামজাদা বাইজীর গৃহে গান-বাজনার কোন আয়োজন কোথাও নাই। এ-ঘর সে-ঘর ঘুরিয়া দোতলায় একটা কোণের ঘরের দরজার স্বমুখে আসিয়া দাড়াইলাম। এটি যে বাইজীর নিজের শয়নমন্দির, তাহা ভিতরে চাহিবামাত্রই টের পাইলাম ; কিন্তু আমার কল্পনার সহিত ইহার কতই না প্রভেদ যাহা ভাবিয়ছিলাম, তাহার কিছুই নাই । মেজেটি শাদা পাথরের, দেয়ালগুলি দুধের মত শাদা ঝকৃঝকৃ করিতেছে। ঘরের একধারে একটি ছোট তক্তপোশের উপর বিছানাপাত, একটি কাঠের আলনায় খান-কয়েক বস্ত্র এবং তাহারই পিছনে একটি লোহার আলমারী। আর কোথাও কিছুই নাই । জুতাপায়ে প্রবেশ করিতে কেমন যেন সঙ্কোচ বোধ হইল –চৌকাঠের বাহিরে খুলিয়া রাখিয়া ভিতরে ঢুকিলাম। বোধ করি ক্লান্তিবশতঃই তাহার শয্যায় আসিয়া বসিয়াছিলাম, না হইলে ঘরে আর কিছু বলিবার জায়গা থাকিলে তাহাতেই বসিতাম। স্বমুখের খোলা জানালী ঢাকিয়া একটা মস্ত নিমগাছ ; তাহারই ভিতর দিয়া বিরঝির করিয়া বাতাস আসিতেছিল। সেইদিকে চাহিয়া হঠাৎ কেমন একটু অন্যমনস্ক হইয় পডিয়াছিলাম। একটা মিষ্ট শব্দে চমকিত হইয়া দেখিলাম, গুনগুন করিয়া গান গাহিতে গাহিতে পিয়ার ঘরে ঢুকিয়াছে। সে গঙ্গায় স্নান করিতে গিয়াছিল, ফিরিয়া আসিয়া নিজের ঘরে ভিজা কাপড় ছাড়িতে আসিয়াছে । সে এদিকে একেবারেই তাকায় নাই । সোজা আলনার কাছে গিয়া শুষ্কবস্ত্ৰে হাত দিতেই, আমি ব্যস্ত হইয়া সাড়া দিলাম—ঘাটে কাপড় নিয়ে যাও না কেন ? পিয়ারী চমকিয়া চাহিয়া হাসিয়া ফেলিল কহিল, অ্যা—চোরের মত আমার ঘরে ঢুকে বসে আছ ? না, না, বোস বোস—যেতে হবে না ; আমি ও-ঘর থেকে কাপড় ছেড়ে আসছি, বলিয়া লঘু পদক্ষেপে গরদের কাপড়খানি হাতে করিয়া বাহির হইয়া গেল। মিনিট-পাচেক পরে প্রফুল্লমুখে ফিরিয়া আসিয়া, হাসিয়া কহিল, আমার ঘরে ত কিছুই নেই ; তবে কি চুরি করতে এসেছিলে বল ত? আমাকে নয় ত? 33