পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/১৮৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।

তাকে মনে মনে শ্রদ্ধা না করে পারিনে। তাঁর স্ত্রী ছিলেন সতীলক্ষ্মী। তিনি মৃত্যুকালে নরেনকে কাছে ডেকে শুধু বলেছিলেন, বাবা, শুধু এই আশীর্বাদই করে যাই, যেন ভগবানের ওপর তোমার অচল বিশ্বাস থাকে। শুনেছি নাকি মায়ের এই শেষ আশীর্বাদটুকু নিষ্ফল হয়নি। নরেন এইটুকু বয়সেই ভগবানকে তার মায়ের মতই ভালবাসতে শিখেছে। যে এ পেরেছে, সংসারে আর তার বাকী কি আছে মা?

বিজয়া প্রশ্ন করিয়াছিল, এইটাই কি সংসারে সব চেয়ে বড় পারা বাবা?

মরণ প্রতীক্ষায় বনমালীর দিন কাটিতেছিল, কন্যার প্রশ্নে তাঁহার শুষ্ক চক্ষু সজল হইয়া উঠিয়াছিল। দুই হাত বাড়াইয়া মেয়েকে বুকের উপর টানিয়া লইয়া বলিয়াছিলেন, এইটিই সব চেয়ে বড় পারা মা! সংসারের মধ্যে, সংসারের বাইরে—বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে এত বড় পারা আর কিছু নেই বিজয়া। তুমি নিজে কোন দিন পারো আর না পারো, এ যে পারে, তার পায়ে যেন মাথা পাততে পারো—আমিও মরণকালে তোমাকে এই আশীর্বাদ করে যাই।

পিতৃবক্ষের উপর উপুড় হইয়া পড়িয়া সেদিন বিজয়ার মনে হইয়াছিল, কে যেন বড় মধুর, বড় উজ্জ্বল দৃষ্টি দিয়া তাহার পিতার বুকের ভিতর হইতে তাহার নিজের বুকের গভীর অন্তস্তল পর্যন্ত চাহিয়া দেখিতেছে। এই অভূতপূর্ব পরমাশ্চর্য অনুভূতি সেদিন ক্ষণকালের জন্য তাহাকে আবিষ্ট করিয়া ছিল। বনমালী কহিয়াছিলেন, ছেলেটির নাম নরেন। তার বাপের মুখে শুনেছি, সে ডাক্তার হয়েছে—কিন্তু ডাক্তারি করে না। এখন যদি এ দেশে সে থাকতো, এই সময়ে একবার তাকে আনিয়ে চোখের দেখা দেখে নিতাম।

বিজয়া জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, এখন তিনি কোথায় আছেন?

বনমালী বলিয়াছিলেন, তার মামার কাছে—বর্মায়। জগদীশের এখন ত আর সব কথা গুছিয়ে বলবার ক্ষমতা নেই, তবু তার মুখের দুই-একটা ভাসা ভাসা কথায় মনে হয়, যেন সে ছেলে তার মায়ের সমস্ত সদ্‌গুণই পেয়েছে। ভগবান করুন, যেখানে যেমন করেই থাক যেন বেঁচে থাকে।

সন্ধ্যা হইয়াছিল। ভৃত্য আলো দিতে আসিয়া, বিলাসবাবুর আগমন-সংবাদ জানাইয়া গেলে, বনমালী বলিয়াছিলেন, তবে তুমি নীচে যাও মা, আমি একটু বিশ্রাম করি।

বিজয়া পিতার শিয়রের বালিশগুলি গুছাইয়া দিয়া, পায়ের উপর শালখানি যথাস্থানে টানিয়া দিয়া, আলোটা চোখের উপর হইতে আড়াল করিয়া দিয়া নীচে নামিয়া গেলে, পিতার জীর্ণ বক্ষ ভেদিয়া শুধু একটা দীর্ঘনিশ্বাস পড়িয়াছিল।