পাতা:শরৎ সাহিত্য সংগ্রহ (প্রথম সম্ভার).djvu/১৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

সকালবেলা বিজয়া চা-পানের পর নীচের বসিবার ঘরে বিলাসবাবুর সহিত বিষয়সম্পত্তি সম্বন্ধে কথাবার্তা কহিতেছিল, বেহারা আসিয়া জানাইল, একজন ভদ্রলোক দেখা করিতে চান।

বিজয়া কহিল, এইখানে নিয়ে এসো।

এই কয়দিন ক্রমাগতই তাহার ইতর-ভদ্র প্রজারা নজর লইয়া যখন-তখন সাক্ষাৎ করিতে আসিতেছিল; সুতরাং প্রথমে সে বিশেষ কিছু মনে করে নাই। কিন্তু ক্ষণকাল পরে যে ভদ্রলোকটি বেহারার পিছনে ঘরে প্রবেশ করিল, তাহার প্রতি দৃষ্টিপাতমাত্রই বিজয়া বিস্মিত হইল। তাহার বয়স বোধ করি পঁচিশ-ছাব্বিশ হইবে। লোকটি দীর্ঘাঙ্গ, কিন্তু তদনুপাতে হৃষ্টপুষ্ট নয়, বরঞ্চ কৃশ। বর্ণ উজ্জ্বল-গৌর, গোঁফ-দাড়ি কামানো, পায়ে চটিজুতা, গায়ে জামা নাই, শুধু একখানি মোটা চাদরের ফাঁক দিয়া শুভ্র পৈতার গোছা দেখা যাইতেছে। সে ক্ষুদ্র একটি নমস্কার করিয়া একখানা চেয়ার টানিয়া লইয়া উপবেশন করিল। ইতিপূর্বে যে-কোন ভদ্রলোক সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছে, শুধু যে নজরের টাকা হাতে লইয়া প্রবেশ করিয়াছে, তাই নয়, তাহারা সভয়ে, কুণ্ঠার সহিত প্রবেশ করিয়াছে। কিন্তু, এ লোকটির আচরণে সঙ্কোচের লেশমাত্র নাই। তাহার আগমনে শুধু যে বিজয়াই বিস্মিত হইয়াছিল, তাই নয়, বিলাসও কম আশ্চর্য হয় নাই। বিলাসের গ্রামান্তরে বাস হইলেও এ-দিকের সকল ভদ্রলোককেই সে চিনিত; কিন্তু এই যুবকটি তাহার সম্পূর্ণ অপরিচিত। আগন্তুক ভদ্রলোকটিই প্রথমে কথা কহিল। বলিল, আমার মামা পূর্ণ গাঙ্গুলীমশাই আপনার প্রতিবেশী, পাশের বাড়িটিই তাঁর। আমি শুনে অবাক হয়ে গেছি যে, তাঁর পিতৃ-পিতামহের কালের দুর্গাপূজা নাকি আপনি এবার বন্ধ করে দিতে চান? এর মানে কি? বলিয়া সে বিজয়ার মুখের প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করিল। প্রশ্ন এবং তাহা জিজ্ঞাসা করার ধরনে বিজয়া আশ্চর্য এবং মনে মনে বিরক্ত হইল, কিন্তু কোন উত্তর দিল না।

তাহার উত্তর দিল বিলাস। সে রুক্ষস্বরে কহিল, আপনি কি তাই মামার হয়ে ঝগড়া করতে এসেছেন নাকি? কিন্তু কার সঙ্গে কথা কচ্ছেন, সেটা ভুলে যাবেন না।

আগন্তুক হাসিয়া একটুখানি জিভ কাটিয়া কহিল, সে আমি ভুলিনি, এবং ঝগড়া করতেও আসিনি। বরঞ্চ, কথাটা আমার বিশ্বাস হয়নি বলেই ভাল করে জেনে যেতে এসেছি।

বিলাস বিদ্রূপের ভঙ্গিতে কহিল, বিশ্বাস হয়নি কেন?