পাতা:শিক্ষা - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
২৩৮
শিক্ষা

মাঝখানে যে প’ড়ে গেছে তার রােখ চেপে যায়, রক্ত গরম হয়ে ওঠে, বাহাদুরির মত্ততায় সে ভোঁ হয়ে যায়। আর, যে লােক বাইরে বসে আছে তার যে কত বড়াে পীড়া এইখানে তার একটা উপমা দিই।

 একদিন আশ্বিনের ভরা নদীতে আমি বজরার জানলায় বসে ছিলেম, সেদিন পূর্ণিমার সন্ধ্যা। অদূরে ভাঙার উপরে এক গহনার নৌকোর ভােজপুরি মাল্লার দল উৎকট উৎসাহে আত্মবিনােদনের কাজে লেগে গিয়েছিল। তাদের কারও হাতে ছিল মাদল, কারও হাতে করতাল। তাদের কণ্ঠে সুরের আভাসমাত্র ছিল না, কিন্তু বাহুতে শক্তি ছিল সে কথা কার সাধ্য অস্বীকার করে। খচমচ শব্দে তালের নাচন ক্রমেই দূন চৌদূন লয়ে চড়তে লাগল। রাত এগারােটা হয়, দুপুর বাজে, ওরা থামতেই চায় না। কেননা, থামবার কোনােই সংগত কারণ নেই। সঙ্গে যদি গান থাকত তা হলে সমও থাকত; কিন্তু অরাজক তালের গতি আছে শান্তি নেই, উত্তেজনা আছে পরিতৃপ্তি নেই। সেই তালমাতালের দল প্রতিক্ষণেই ভাবছিল ভরপুর মজা হচ্ছে। আমি ছিলেম তাণ্ডবের বাইরে, আমিই বুঝছিলেম গানহীন তালের দৌরাত্ম্য বড় অসহ্য।

 তেমনি করেই আট্‌লান্‌টিকের ও পারে ইঁটপাথরের জঙ্গলে ব’সে আমার মন প্রতিদিনই পীড়িত হয়ে বলেছে, তালের খচমচ’র অন্ত নেই, কিন্তু সুর কোথায়! আরো চাই, আরাে চাই, আরাে চাই। —এ বাণীতে তো সৃষ্টির সুর লাগে না। তাই সেদিন সেই ভ্রূকুটিকুটিল অভ্রভেদী ঐশ্বর্যের সামনে দাঁড়িয়ে ধনমানহীন ভারতের একটি সন্তান প্রতিদিন ধিক্কারের সঙ্গে বলেছে: ততঃ কিম্!

 এ কথা বারবার বলেছি, আবার বলি, আমি বৈরাগ্যের নাম ক’রে শূন্য ঝুলির সমর্থন করি নে। আমি এই বলি, অন্তরে গান ব’লে সত্যটি যদি ভরপুর থাকে তবে তার সাধনায় সুর-তাল রসের সংযমরক্ষা করে; বাহিরের বৈরাগ্য অন্তরের পূর্ণতার সাক্ষ্য দেয়। কোলাহলের উচ্ছৃঙ্খল নেশায় সংযমের কোনাে