পাতা:শ্রীকান্ত - শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়.pdf/৩৭৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ड R এই অনারব্ধ সংসারের মাঝখানে তিনি যেন মন্ত বড় একটা ছিদ্র করিয়া দিয়া গেলেন । এই অনিষ্টটি আপনা হইতেই সারিয়া উঠিবে কিংবা নিজেই তিনি আবার একদিন আমনি অকস্মাৎ ভঁাহার প্রচণ্ড ঔষধের বাক্সটা ঘাড়ে করিয়া ইহা মেরামত করিতে সশরীরে ফিরিয়া আসিবেন, বিদায়কালে কিছুই বলিয়া গেলেন না। অথচ আমার নিজের খুব যে বেশি উদ্বেগ ছিল তাও নয়। নানা কারণে এবং বিশেষ করিয়া কিছুকাল হইতে জ্বরে ভুগিয়া দেহ ও মনের এমনই একটা নিস্তেজ নিরালম্ব ভাব আসিয়া পড়িয়াছিল যে একমাত্র রাজলক্ষ্মীর হাতেই সর্বতোভাবে আত্মসমৰ্পণ করিয়া সংসারের যাবতীয় ভাল-মন্দর দায় হইতে অব্যাহতি লইয়াছিলাম। সুতরাং কিছুর জন্যই স্বতন্ত্রভাবে চিন্তা করিবার আমার আবশ্যকও ছিল না, শক্তিও ছিল না। তবুও মানুষের মনের চঞ্চলতার যেন বিরাম নাই, বাহিরের ঘরে একটা তাকিয়া ঠেস দিয়া একাকী বসিয়া আছি, কত যে এলোমেলো ভাবনা আনাগোনা করিতেছে তাহার সংখ্যা নাই, সম্মুখের প্রাঙ্গণতলে আলোর দীপ্তি ধীৰে ধীরে মান হইয়া আসন্ন রাত্রির ইঙ্গিতে অন্যমনস্ক মনটাকে মাঝে মাঝে যেন এক একটা চমক দিয়া যাইতেছে, মনে হইতেছে এ জীবনে রাত্ৰি আসিয়াছে গিয়াছে তাহাদের সহিত আজিকার এই অনাগত নিশার অপরিজ্ঞাত মুক্তি যেন কোন অদৃষ্টপূর্ব নারীর অবগুষ্ঠিতা মুখের মত রহস্যময়। অথচ, এই অপরিচিতার কেমন প্ৰকৃতি, কেমন প্ৰথা কিছুই না জানিয়া একেবারে ইহার শেষ পৰ্যন্ত পৌছিতেই হইবে, মধ্য-পথে আর ইহার কোন বিচারই চলিবে না ! আবার পরীক্ষণেই যেন অক্ষম চিন্তার সমস্ত শৃঙ্খলই এক নিমেষে ভাঙ্গিয়া বিপৰ্যন্ত হইয়া যাইতেছে। এমনি যখন অবস্থা, সেই সময় পাশের দ্বারটা খুলিয়া রাজলক্ষ্মী প্ৰবেশ করিল। তাহার চোখ দুটা সামান্য একটু রাঙা, একটু যেন ফুল-ফুল। ধীরে ধীরে আমার কাছে আসিয়া বসিয়া বলিল, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কহিলাম, আশ্চৰ্য্য কি ! যে ভার, যে শ্ৰান্তি তুমি বয়ে বেড়াচ্ছ, আর <কেউ হ’লে তা ভেঙেই পড়ত, আর আমি হ’লে তা দিনরাতের মধ্যে চোখ খুলতেই পারতুম না, কুম্ভকর্ণের নিদ্ৰা দিতুম।