পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৩০ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-দ্বিতীয় খণ্ড বিষাক্ত ছিল না যে খাইয়াই বালক দুটি অজ্ঞান হইয়া পড়িবে? এ আর কিছু নহে, ইহা দেবলীলা । বিজয়কৃষ্ণ পাঠক তাহার পুত্রদ্বয়ের মৃত্যু ঘটনা দেবলীলা বলিয়াই বোধ করিলেন; তখন দেবতার উপর ভক্তের অভিমান হইল, তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন আর দেবসেবা করিবেন না। দেবতা অজ্ঞান বালকের দোষ গ্রহণ করিলেন কেন? অজ্ঞানের জ্ঞানাভাব দোষেই যদি মৃত্যুদণ্ড বিহিত হয়, তবে ইচ্ছাপূৰ্ব্বক পূজাপরিত্যাগের প্রত্যবায় জনিত দোষেও মৃত্যুদণ্ড প্রযুক্ত হউক। পুত্রদ্বয়কে দেবতা যে পথে নিয়াছেন, তিনিও সে পথেই যাইতে চাহেন; কাজেই তিনি প্রতিজ্ঞা করিলেন—আর দেবসেবা করিবেন না । গোবিন্দ ঘোষের কীৰ্ত্তিও এইরূপ। শ্ৰীমহাপ্ৰভু নীলাচল হইতে বৃন্দাবনোদেশে যখন রামকেলি পর্যন্ত গমন করেন, তখন পদকৰ্ত্তা গোবিন্দ ঘোষ তাহার সঙ্গে ছিলেন। ঐ সময় শ্ৰীমহাপ্ৰভু প্রায় সৰ্ব্বসময় কৃষ্ণপ্রেমে একরূপ বাহ্যজ্ঞান বিরহিত রহিতেন। অভ্যাস বশেই স্নানাহাবাদি চলিত। একদা আহারান্তে মুখসিদ্ধির জন্য তিনি হরীতকী পাইতে হাত পাতিলেন, নিকটে গোবিন্দ ঘোষ ছিলেন, অভিপ্রায় বুঝিয়া তিনি দৌড়িয়া গ্রামে গেলেন ও একটা হরীতকীর অৰ্দ্ধাংশ আনিয়া দিলেন। পরদিন প্ৰভু অগ্রদ্বীপে উপস্থিত হইয়া তেমনি হরীতকীর আনিয়া অৰ্দ্ধাংশ দিলেন। পরদিন প্ৰভু অগ্রদ্বীপে উপস্থিত হইয়া তেমনি হরীতকীর জন্য হাত পাতিলেন, গোবিন্দ অগ্রবত্তী হইয়া তখন হরীতকীর অপরাদ্ধ প্রদান করিলেন । সৰ্ব্বদা যিনি ভাবান্তরে বাহ্য বিস্তৃত, গোবিন্দ হরীতকী খণ্ড দিবা মাত্র তিনি সম্পূর্ণ বাহ্যজ্ঞান প্রাপ্ত হইলেন। এবং গোবিন্দকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন– “গোবিন্দ! তোমার সঞ্চয় বুদ্ধি এখনও রহিয়াছে, তুমি গৃহত্যাগের উপযুক্ত হও নাই, কিছুকাল গৃহধৰ্ম্ম কর।” গোবিন্দ বিবাহদি করেন নাই এবং উদাসীন ব্রতী ছিলেন, এক্ষণে মহাপ্রভুর আদেশে তাহাকে অগ্রদ্বীপে থাকিতে হইল। অগ্রদ্বীপে তিনি বিবাহ করিলেন ও গোপীনাথ বিগ্রহ স্থাপন করিলেন। কালক্রমে তাহার একটি পুত্র জাত হইল। গোপীনাথের প্রতি গোবিন্দের যে বাৎসল্য ছিল, এক্ষণে পুত্রও সেই প্রীতির অংশ গ্রহণ করিল। এই সময় একদিন হঠাৎ তাহার পুত্রের মৃত্যু হওয়ায় গোবিন্দ, গোপীনাথের ঘাড়ে সকল দোষ চাপাইয়া অভিমান করিয়া বসিলেন। সেবা পূজা বন্ধ হইল, গোবিন্দ বলিতে লাগিলেন— “গোপীনাথের পূজা করিয়া আমার পিণ্ড প্রাপ্তির আশা লুপ্ত হইল, ইহাই তো পূজার ফল! আমি আর গোপীনাথের পূজা করিব না।" ইহার পর গোপীনাথ কর্তৃক পিণ্ডদানের ব্যবস্থা হইল এবং গোবিন্দও পূৰ্ব্বমত পূজায় বৃত হইলেন। অগ্রদ্বীপে আজ পর্যন্ত প্রতিবৎসর গোপীনাথ বিগ্ৰহ গোবিন্দ ঘোষকে১ পিণ্ড প্রদান করিয়া আসিতেছেন! ভগবানের প্রতি ভক্তের—উপাস্যের প্রতি উপাসকের এইরূপ প্রেমাভিমান তাহাদের সামান্য ভক্তি নিষ্ঠার পরিচায়ক নহে। এইরূপ প্রেমেই ভগবানকে ভক্তের ভক্তের বশ্যতা স্বীকার করিতে হয় । বিজয়কৃষ্ণ প্রতিজ্ঞা করিলেন—আর দেবসেবা করিব না। কাজেই এই প্রগাঢ় প্রেমের প্রতিদানে দেবতাকে তাহার অভাব পূরণ করিতে হইল, স্বীকার করিতে হইল যে, তাহাদের ক্রটি গৃহীত হইবে না। বাসুদেব বিজয়ের প্রেমে মুগ্ধ, বিজয়ও বাসুদেবের একান্ত ভক্ত; তাই বাসুদেব বিজয় এবং বিজয়ের বংশধর ব্যতীত অন্য কাহারও দ্বারা পূজিত হইতে চাহেন না। বিজয় যথাকালে পুত্রের হাতে সেবা সমর্পণ করিয়া যোগ্যধামে গমন করিলেন । ১. ইহার ভ্রাতৃবংশ-বিবরণ দক্ষিণ শ্রীহট্টের বংশ বৃত্তান্ত খণ্ডে কথিত হইবে।