পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/২৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৩৮ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-তৃতীয় খণ্ড আগমন করেন বলিয়া কথিত আছে। যখন বল্লাল সেনের কৌলীন্যপ্রথা প্রচারিত হয়, তখন যাহারা তদীয় প্রতিবাদী হইয়াছিলেন, এই বংশের আদিপুরুষ তাহার একতম; ইহারা শাণ্ডিল্য গোত্রীয় মৌলিক কুলীন সন্তান। মেদিনীধর নামে এক ব্যক্তি সেই বংশে জন্ম গ্রহণ করেন। মেদিনীধর হইতে এ বংশের কথা জ্ঞাত হওয়া যায়, তিনি বিশেষ দক্ষ ব্যক্তি ছিলেন; ইটাভূমি-পতি নিধিপতির জনৈক সন্ততি হইতে তিনি গয়ঘড় মৌজায় কতকভূমি প্রাপ্ত হন ও তথায় গিয়া বাস করেন। ইহারা পূৰ্ব্বে উপবীত-ধারী ছিলেন, পরে কায়স্থ সমাজের সহিত বিবাহাদি সম্বন্ধে সম্মিলিত ও উপবীত ত্যাগী হন বলিয়া কথিত হয়। মেদিনীধরের পুত্রের নাম পদ্মনাথ, ইহার পুত্র বংশীদাস, তৎপুত্র বিজয়রাম, বিজয়রামের পুত্র শ্রীনাথদত্ত, শ্রীনাথের পুত্র পুরুষোত্তম । ইহার তিন পুত্র, তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ দুর্গাভর হংসখলা গ্রামে একদীঘী খনন করেন, উহা দুর্গাভরের দীঘী বলিয়া খ্যাত আছে। মধ্যম পুত্রের নাম হরিনাথ দত্ত, হরিনাথের পুত্র ভুবনানন্দ, ইহার পুত্র প্রসিদ্ধ হৃদয়ানন্দ দত্ত কানুনগো একদা এক বিচিত্র স্বপ্ন দর্শন করেন। কথিত আছে, তদনুসারে পরদিন প্রভাতে ব্রাহ্মণ ও বহুব্যক্তি সহ স্বীয় পুষ্করিণীর ঘাটে গিয়া ব্রাহ্মণকে জলে নামাইলেন। ব্রাহ্মণ জলে অন্বেষণ করিতে করিতে গৌরীপাট সহ উমামহেশ্বর শিবের এক পাষাণ মূৰ্ত্তি প্রাপ্ত হইলেন। তৎসহ গায়কের ব্যবহারোপযোগী “তালচর” প্রভৃতি আরও কয়েকটি দ্রব্য ও তাম্রপত্রে লিখিত উমামহেশ্বরের ধ্যানাদি প্রাপ্ত হন। হৃদয়ানন্দ নিজ ভ্রাতা ষষ্ঠীবর দত্ত সহ পরামর্শ ক্রমে বহিৰ্ব্বাটিকায় এক গৃহ নিৰ্ম্মাণ করিয়া দেবতাকে সংস্থাপিত করেন। চৈত্র-সংক্রান্তি যোগে এই দেবতার সম্মুখে চরক পূজা হইত। হৃদয়ানন্দ অতি সুগায়ক ছিলেন, কথিত আছে যে তিনি যখন মেঘমল্লার রাগিনীতে সঙ্গীত আরম্ভ করিতেন, তখন মেঘাড়ম্বর হইত। এই হৃদয়ানন্দের ভনিতিযুক্ত পদ্মা-পুরাণের অনেকটি লাচাড়ী ও কবিতা পাওয়া যায়। কবিষষ্ঠীবর সংবাদ ষষ্ঠীবর একজন উৎকৃষ্ট গায়ক ছিলেন; তৎকর্তৃক এতদঞ্চলে "ডরাই" পূজার গানের নিয়ম প্রচলিত হয়। তিনি বিস্তারিত রূপে “পদ্মাপুরাণ" রচনা করিয়া অমর হইয়া রহিয়াছেন। তাহার রচিত “পদ্মাপুরাণ" কেবল শ্রীহট্টের ঘরে ঘরেই প্রচলিত নহে, পূৰ্ব্ব বঙ্গের বহুস্থানে ষষ্ঠীবরে এই গ্রন্থ পাওয়া যায়। পূৰ্ব্ববঙ্গে পদ্মাপুরাণের অনেক রচয়িতা আছেন, শ্রীহট্ট জেলাতেই দ্বাবিংশতাধিক পদ্মাপুরাণ রচয়িতার সংবাদ প্রাপ্ত হই, ইহাদের মধ্যে ষষ্টীবর ও নারায়ণ দেবই অধিক ভাগ্যবান; রচনা, ভাব ও লালিতে ইহাদের পদ্মাপুরাণই সৰ্ব্বাদৃত। ষষ্টীবর নিজ কৃতিত্ব জ্ঞাত ছিলেন, তাহার গ্রন্থের মধ্যে এই ভনিতি পাওয়া যায়ঃ “কহে ষষ্টীবর কবি কষ্ঠে ভারতী দেবী জয়দেবী মনসার চরণ " কথিত আছে স্বগীয় বিষহরির বরে ষষ্টীবরের বংশীয় কাহাকেই সৰ্প দংশন করেনা; এই বংশীয় কোন ব্যক্তিও সপ বধ করেন না। ডরাই গানের স্রষ্টা কবি ষষ্টীবর তালচর হাতে লইয়া পদ্মাপুরাণ গান করিতেন। ভক্তকবির মুখে সে গান বড়ই সুন্দর শুনাইত। প্রতিবেশী জনৈক ব্রাহ্মণ দ্বারা হৃদয়ানন্দ ও ষষ্টীবর পূজা করাইতেন; এই ব্রাহ্মণ সেই তালচর ও ধ্যান প্রাপ্ত হন এবং তাহার নিকট হইতে পদ্মাপুরাণ গান শিক্ষা করেন।