পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/২৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৮৮ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-চতুর্থ খণ্ড প্রার্থনা করিলে, পণ্ডিতপ্রবর তাহাতে স্বীকৃত হইলেন। রাজা তখন তাহাকে বহুতর ব্ৰহ্মত্র প্রদান করিলেন ও তাহার নিকট হইতে মন্ত্র গ্রহণ করিলেন। কর্ণখা গুরুকে যে সমস্ত ভূমি দান করেন, তিনি তৎসমস্ত গ্রহণ না করিয়া একখানা বাড়ী ও অল্প কতক জমি মাত্র গ্রহণ করিলেন; জীবনধারণোপযোগী বিত্ত ব্যতীত গ্রহণ করিলেন না; কেননা বহু বিত্ত লোভ ও বিলাসিতার প্রসূতি। কর্ণখা যাত্রাপাশা নামক পল্লীতে পুষ্করিণী সমন্বিত একটি বাটী প্রস্তুত ক্রমে গুরুকে তাহা সমর্পণ করিলেন। কর্ণখা শ্ৰীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কারকে গুরু স্বীকার করিয়া বাণিয়াচঙ্গে সংস্থাপিত করিলে, বাণিয়াচঙ্গের অপরাপর ব্রাহ্মণবর্গও তাহার বিষ্যত্ব স্বীকার করেন।৬ ইহার নিকট হইতে তত্ৰত্য সকলেই শাস্ত্রীয় ব্যবস্থাদি গ্রহণ করিতে লাগিল; রাজগুরু তখন তত্ৰত্য "সমাজপতি" হইয়া উঠিলেন। রাজাও তাহার সম্মানার্থ এই নিয়ম প্রচারিত করিলেন যে, উৎসবোলক্ষে যথায় দধিচিড়া ভোজনের আয়োজন হইবে, এই বংশীয় ব্যক্তিবর্গের জন্য সেস্থলে অন্নব্যঞ্জনের ব্যবস্থা করিতে হইবে। পাকা মিষ্টান্নাদির আয়োজন হইলে, ইহাদিগকে পৃথক পাকে দেওয়া হইবে। গর্ভাধান ও জাতকৰ্ম্মাদি এবং শ্ৰাদ্ধাদিতে ইহাদিগকে কেহ নিমন্ত্ৰণ করিতে পারিবে না ইত্যাদি। রাজা এই সময় তর্কালঙ্কারকে ২৮ পরগণার রাজপণ্ডিতি প্রদান করেন। তাহার দুইপুত্র-শ্রীরাম ও হরিরাম । শ্রীরাম ও শলাকা পরীক্ষা শ্রীরাম পিতার নিকট শিক্ষালাভ করিয়া ন্যায় শিক্ষার্থ মিথিলায় গমন করেন ও বিশারদ উপাধি লাভ করিয়া দ্বাবিংশতি বর্ষ বয়সে কাশী হইয়া দেশে আগমন পূৰ্ব্বক তিনি তান্ত্রিক সাধনায় বৃত হন ও অচিরেই অসাধারণ আধ্যাত্মিক শক্তি লাভে সমর্থ হন। ইহার পর তিনি “শলাকা পরীক্ষায়” উত্তীর্ণ হইয়া বঙ্গবিখ্যাত পণ্ডিত রূপে গণ্য হন। সৰ্ব্বশাস্ত্ৰদশী অগাধ জ্ঞান-গৰ্ব্বিত বিজ্ঞ পণ্ডিতও ক্কচিৎ এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইতে পারেন। বিবিধ শাস্ত্রগ্রন্থের ২/১টা করিয়া পত্র সমষ্টি একত্র মিশ্ৰিত করিয়া রাখা হইলে, পরীক্ষার্থীকে একটা লৌহ-শলাকা দ্বারা তাহাতে আঘাত করিতে হইত, তাহাতে যে যে গ্রন্থের পত্র শলাকা বিদ্ধ হইত, সেই সকল গ্রন্থের কঠিনাংশগুলি পরীক্ষার্থীদের অনর্গল বলিতে ও ব্যাখ্যা করিতে হইত। শলাকা পরীক্ষায় কত জটীল গ্রন্থের পত্র সংগৃহীত হইত, পরীক্ষা দর্শনের জন্য কত লোকের সমাগম ঘটিত, এবং কত ছাত্রেরই চেষ্টা বিফলীকৃত হইয়া যাইত তাহার সংখ্যা করা যায় না; সুতরাং শলাকা পরীক্ষার্থী ছাত্রগণের বহুশাস্ত্রে জ্ঞান থাকা আবশ্যক হইত; বহু জটিল গ্রন্থে দৃষ্টি থাকা ও তাহা একরূপ কণ্ঠস্থ রাখা প্রয়োজন হইত। বিশারদ এই অগ্নি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া, দেশের মুখ উজ্জ্বল করিয়াছিলেন; ইহাতে এই ফল হইল যে, অচিরেই তাহার শিষ্য সংখ্যা বিবৰ্দ্ধিত হইয়া উঠিল; কেবল পূৰ্ব্বনিবাস ফরিদপুর নহে, ঢাকা ময়মনসিংহ প্রভৃতি বহুস্থানের লোক আসিয়া তাহার শিষ্যত্ব স্বীকার করিল। আজ পৰ্য্যন্ত ঐসকল স্থানে ইহাদের শিষ্য সম্পদ আছে। বিশারদ এইরূপে প্রতিদ্বন্দ্বিতা-বিরহিত অখণ্ড যশোভাণ্ডারের অধিকারী হইয়াও অধিক দিন গৃহে অবস্থিতি করিলেন না, পণ্ডিতগণ এসকল সাংসারিক উন্নতিকে আধ্যাত্মিক অবনতির কারণ বলিয়াই বোধ করেন; অতএব তিনি ভুক্তদধি-ভাগুবৎ তৎপরিত্যাগপূৰ্ব্বক কামরূপে উপস্থিত ৬. লাহ্মণ-বহুল বাণিয়াচঙ্গের যে সকল ব্রাহ্মণ মোসলমান রাজার অধীনে কাৰ্য্য করেন নাই, তাহাদের মধ্যে না কি গৌতম বংশীয়গণের শিষ্য কেহ কোনও দিন ছিল না এবং এখনও অতি অল্পই আছে বলিয়া আমরা বিশ্বস্ত সূত্রে শুনিয়াছি । বলাবাহুল্য এই বিবরণী গৌতম বংশীয় ব্যক্তি প্রদত্ত এবং এস্থলে তদনুসারেই আমরা লিখিতে বাধ্য হইলাম ।