পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/২৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৯২ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-চতুর্থ খণ্ড ব্যাপারের চিত্র তদীয় চিত্ত-ফলকে প্রতিফলিত হইত। তাহার ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে ফলিয়া যাইত, অনেকেই তাহা পরীক্ষা করিয়া বিস্মিত হইয়াছিলেন । একদিন তিনি আপনার ননদী ও দেবর-জায়াকে সহাস্য বদনে বলিলেন—“আমরা কাল তোমাদিগকে ছাড়িয়া চলিয়া যাইব, ছেলে দুটিকে তোমাদের হাতে সঁপিয়ে দিলাম।” রমণীদ্বয় তাহার বাক্যের তাৎপৰ্য্য গ্রহণ করিতে না পারিয়া ইহা পরিহাস বলিয়াই মনে করিলেন। সতীর স্বামী তখন সুস্থ শরীরে গৃহে ছিলেন, কিন্তু পরদিন হঠাৎ তাহার শরীর অসুস্থ হইয়া পড়িল-মায়বিক দুৰ্ব্বলতা বশতঃ দেখিতে দেখিতে তিনি অবসন্ন হইয়া পড়িলেন। তখন সতীর পূৰ্ব্বদিনের উক্তি আলোচনায় আত্মীয়বর্গ ভীত হইয়া পড়িলেন। এদিকে সতী নিশ্চিন্তভাবে স্নানান্তে শিবাচ্চনা করিয়া আসিলেন, রামরাম ততক্ষণ পরিজন পরিবৃত ভাবে মৃত্যুশয্যায় শায়িত হইয়াছেন। দেবগৃহ হইতে বহির্গত হইয়া সতী জনে জনে বিদায় লইলেন। স্ত্রী মহলে উচ্চ ক্ৰন্দন-ধ্বনি উঠিয়াছে; সতী অবিকৃতচিত্তে পতিসদনে আসিলেন ও ভক্তিভাবে মুমূর্ষ স্বামীর চরণে মস্তক ন্যস্ত করিয়া, ধ্যান-স্তিমিত-নেত্ৰে হাসিতে হাসিতে চলিয়া গেলেন; শূন্যপ্রাণ দেহ পতিপদে পড়িয়া রহিল! ক্ষণপূৰ্ব্বে বদনে যে হাস্যরেখা দেখা গিয়াছিল, তাহা আরও যেন স্পষ্ট হইয়া উঠিল, দেখিয়া দর্শকবৃন্দ স্তম্ভিত হইয়া রহিল, ক্ৰন্দন কোলাহল মুহূৰ্ত্তে থামিয়া গেল। পতিভক্তির এমন জীবন্ত দৃষ্টান্ত কেহ কখন দেখে নাই, শুনেও নাই। কি শক্তিবলে সতী স্বেচ্ছায় পতির অগ্ৰে দেহ ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন, কেহ বুঝিল না; তাহারা কিয়ৎকাল কিংকৰ্ত্তব্যবিমুঢ়বৎ স্তম্ভিত হইয়া রহিল। তাহার পরে সকলে সমস্বরে সতীর জয়ধ্বনী দিয়া উঠিল। রামরামের শেষ শ্বাস তখনও মহাকাশে মিলে নাই। অবশেষে প্রতিবেশী দর্শকের নিরাশ আহবানে, তাহাদের ভক্তিপূত জয়ধ্বনিতে যখন তাহার চমক ভাঙ্গিল, সতীর মহাপ্রস্থানের কথা জানিতে পারিলেন, তখন তাহারও গমনোন্মুখ প্রাণ দেহ ছাড়িয়া পত্নীর পথানুসরণ করিল। সতীর বাক্য সফল হইল, পতিপত্নী একসঙ্গে অনন্তধামে চলিয়া গেলেন। সৰ্ব্বানন্দের কথা রামরামের দুই পুত্র, শ্রীকান্ত ও সৰ্ব্বানন্দ । উভয়েই কালক্রমে পরম পণ্ডিত হইয়া উঠেন। সৰ্ব্বানন্দ উপাধি গ্রহণে নিতান্ত ইচ্ছুক হইয়া পড়েন। আত্মীয়বর্গ নিষেধ করিলে বলিতেন—“স্বয়ং মহাদেবের পৌত্রকে দাম্ভিক দিশ্বজয়ীর অভিশাপে কি করিবে?" আত্মীয়গণ তখন অল্প বয়সেই তাহার বিবাহ দেন, সেই স্ত্রীর গর্ভে উপাধি গ্রহণের পূৰ্ব্বেই তাহার কৃষ্ণানন্দ নামে এক পুত্র জাত হয়; সৰ্ব্বানন্দ তৎপরে “বিদ্যালঙ্কার” উপাধি গ্রহণে পণ্ডিত-সমাজে সুপরিচিত হন। এই সময়ে তাহার খুল্লতাত-ভ্রাতা বিদ্যানন্দ কৌলিক শিষ্যাদি বিভাগ করিয়া লইয়াছিলেন; কিন্তু তিনি দস্যভয়ে বরদাখাত প্রভৃতি দূরবত্তী অঞ্চলে শিষ্যশাসনে যাইতেন না; তাহাতে যে সব অঞ্চলের বহু শিষ্য দেশে অপর গুরু স্বীকার করিতে বাধ্য হয়। সৰ্ব্বান্দের প্রকৃতি ভিন্নরূপ ছিল, তিনি দূরদেশে যাইতেই বিশেষ উৎসাহী ছিলেন। একদা বিক্রমপুরে একস্থানে গিয়াছেন, তথায় মহেশ্বরদিবাসী কয়েক ব্যক্তি তাহার পরিচয় পাইয়া বলিল যে, তিনি তাহাদের কৌলিক গুরুপুত্র; তাহারা বহুদিন গুরুবংশীয় কেহকে না পাইয়া অন্যত্র দীক্ষিত হইয়াছে। তাহাদের বিশেষ অনুরোধে সৰ্ব্বানন্দকে মহেশ্বরদি যাইতে হইল, পথে তাহার নৌকা দসু্যকর্তৃক আক্রান্ত হয়। কথিত আছে যে, তিনি তখন মাঝি মাল্লাকে নৌকার ভিতরে ডাকয়া আনিয়া এক অদ্ভুত স্বরে তান্ত্রিক মন্ত্রোচ্চারণ করিতে লাগিলেন আর সকলে দেখিয়া চমকিত হইল যে, আক্রমণকারী সাতটি দসু্য তাহার নৌকায় উঠিয়াই মৃগীগ্রস্ত রোগীর