পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪২৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

২৬ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ পাইয়াছে, সেই স্বয়ংপ্রকাশ বস্তুকে অপ্রকাশ রাখার চেষ্টা কতদূর ফলপ্রদ, তাহাই দেখা।" এমন সময় বাহিরে বহুলোক-তাহারা সদ্য আগত পূৰ্ব্ববঙ্গের তীর্থযাত্রী, “জয় শ্ৰীকৃষ্ণ চৈতন্য" বলিয়া ধ্বনি করিয়া উঠিল। শ্রীবাসাদি সেই ধ্বনির সহিত কণ্ঠ মিলাইয়া বলিলেন “কেমন প্রভো; ইহাদিগকে তো কেহ শিখাইয়া দেয় নাই; তবে এ জয়ধ্বনি কেন?" শ্ৰীমহাপ্রভু আর কিছু বলিলেন না, ভক্তেরই জয় হইল। এইরূপে কয়েক বৎসর অতীত হইল। একদা অদ্বৈত শ্ৰীমহাপ্রভুর নিকট একটি প্রহেলিকা বাক্য২৪ প্রেরণ করিলেন, এই প্রহেলিকা-বাক্য শ্রবণে শ্রীচৈতন্যদেব ঈষদ্ধাস্য পূৰ্ব্বক তৃষ্ণীভূত হইয়া রহিলেন । ভক্তবর্গ এই গঢ়াৰ্থবোধক বাক্যের অর্থ পরিগ্রহ করিতে না পারিয়া শ্ৰীমহাপ্রভুকে তাহার তাৎপৰ্য্য জিজ্ঞাসিলে তিনি বলিয়াছিলেন, “আচাৰ্য্য তন্ত্রজ্ঞ পূজক, তিনি দেবতার আবাহন করিয়া পুনঃ যথা সময়ে বিষৰ্জ্জন করিয়া থাকেন, তাহার কথার অর্থ তিনিই বুঝেন।” ইহার পর হইতেই শ্ৰীমহাপ্রভুর ভাব অন্যরূপ হইল, তিনি একরূপ বাহ্য জ্ঞান বিরহিত হইয়াই সৰ্ব্বদা থাকিতেন; এবং তদবস্থায় অপ্রকট হন। অপ্রকটের পর প্রহেলীর অর্থ ভক্তবর্গ বুঝিতে পারিয়াছিলেন; এই প্রহেলিকা তদীয় লীলা সম্বরণের জন্য ইঙ্গিত মাত্র। বঙ্গীয় বৈষ্ণব সমাজে অদ্বৈতের স্থান অতি উচ্চে, তিনি শিবের (কোন কোন মতে মহাবিষ্ণুর) অবতার বলিয়া পুজিত। এই মত যে পরবর্তী কালে অদ্বৈত-ভক্ত কর্তৃক পরিকল্পিত হয়, তাহা নহে; শ্ৰীমহাপ্রভুর অন্তরঙ্গ অনুচর স্বরূপ গোস্বামী এই মতের উদ্ভাবক। বঙ্গীয় বৈষ্ণব সমাজে ভাব ও শক্তি বিশেষের অবতরণ স্বীকৃত হইয়াছে। কৰ্ম্মবশে অনশ্বর আত্মার জন্মান্তর গ্রহণের ন্যায় মুক্তপুরুষ বা দেবতার স্বেচ্ছাতঃ দেহধারণও স্বীকৃত হয়। সে যাহা হউক, শ্রীহট্টবাসী অদ্বৈতাচাৰ্য বৈষ্ণব জগতে মহাবিষ্ণু বা মহাদেবের অবতার রূপে পূজিত হইতেছেন, ইহা শ্রীহট্টবাসিগণের কম গৌরবের কথা নহে। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তৰ্দ্ধানের পরও অনেক দিন অদ্বৈত জীবিত ছিলেন, কিন্তু ঐ সময় তাহার বাহ্য জ্ঞান প্রায় ছিল না; অভ্যাস বশেই মানাহার করিতেন। অদ্বৈত-প্রেরিত পূৰ্ব্বোক্ত প্রহেলিকা-পদ্য প্রাপ্তির পর শ্ৰীমহাপ্রভুর শেষ কয়েক বৎসর যেমন কৃষ্ণবিরহে বাহ্যজ্ঞান বিহীন ছিলেন, অদ্বৈতও তেমনি শেষ কয়েক বৎসর গৌর-বিরহে বিহবল ছিলেন ও তদবস্থায় শতাব্দজীবী২৫ শিবাবতার অদ্বৈতাচাৰ্য্য অপ্রকট হন। ২৪. শ্ৰী অদ্বৈত প্রেরিত প্রহেলিকা, যথা : “বাউলকে কহিও লোক হইল বাউল । বাউলকে কহিও হাটে না বিকায় চাউল৷ বাউলকে কহিও কাজে নাহিক আউল । বাউলকে কহিও ইহা করিয়াছে বাইল ।” পণ্ডিত রাম নারায়ণ বিদ্যারতু ইহার এই অর্থ করিয়াছেন যে, কৃষ্ণ প্রেমোন্মত্তকে (শ্ৰী মহাপ্রভুকে) বলিও—লোক কৃষ্ণ প্রেমে উন্মত্ত হইয়াছে; আর কেহ বাকী নাই যে কৃষ্ণ প্রেম নিবে-প্রেম আর বিকায় না। আর বলিও যে এই প্রেম বিতরণ কার্যে কোন ক্রটি হয় নাই। আর পাগল অদ্বৈতই ইহার বক্তা। (পাগল ব্যতীত কে নিদারুন বিদায়ের কথা ইঙ্গিত করিতে পারে?) ২৫. প্রেম বিলাসে লিখিত আছে শ্ৰীমহাপ্রভুর অন্তৰ্দ্ধানের চারিবৎসর পরে অর্থাৎ ১৫৩৭ খৃষ্টাব্দে ১০৩ বৎসর বয়সে তিনি স্বধাম গমন করেন। কিন্তু অদ্বৈত প্রকাশ মতে তাহার অপ্রকট কাল ১২৫ বৎসর যথাঃ– "সওয়াশত বর্ষ প্রভু রহি ধরা ধামে । অনন্ত অৰ্ব্বদ লীলা কৈলা যথা কালে।" এত দীর্ঘকালও যে লোক বাচিতে পারে, ইহার উদাহরণ এখনও একদা অপ্রাপ্য নহে। তাহা হইলে ১৫৫৮ খৃষ্টাব্দে তাহার অন্তৰ্দ্ধান কাল বলিতে হয়।