পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৩৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবন বৃত্তান্ত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ৪১ কথিত আছে যে, একটি ভীষণ ব্যাঘ্ৰ বঞ্চিতের অনুসরণ করিয়াছিল; যখন বনভূমি উত্তীর্ণ হইয়া বঞ্চিত লোকালয়ে উপস্থিত হন, তাহার পাছে পাছে কুকুরের মত একটা ভীষণ ব্যাঘ্ৰ আসিতেছে দেখিয়া লোকে বিস্মিত হয় ও তাহাকে সিদ্ধ পুরুষ বলিয়া জ্ঞান করে। বঞ্চিত বাড়ীতে পৌছিলে অনেকেই তাহাকে দেখিতে আসে; বহুজন সমাগম দৃষ্টে ব্যাঘ্রটি বিদ্যুৎ বেগে ধাবিত হইয়া বনে চলিয়া যায়। ব্যাঘ্রটিকে বঞ্চিত আনিয়াছিলেন বলা যাইতে পারে; কোন মহাশক্তি পরিচালিত হইয়া ভীষণ পশুটি বঞ্চিতকে বাড়ী পৌছাইয়া দিয়া গেল, কে জানে? বঞ্চিত গৃহে আসিলেন, গ্রামে কোলাহল উপস্থিত হইল শত শত লোক লোকালয়ে। সমবেত হইয়া হরিধ্বনি দিতে লাগিল, মুহূৰ্ত্ত মধ্যে সংকীৰ্ত্তনে গ্রাম মুখরিত হইয়া উঠিল, বঞ্চিত বলিতে লাগিলেন । * “হরে কৃষ্ণ রাম নিত্য গুণ ধাম, মনে রাইখ অবিরাম । অনিত্য বিষয় সুখের লাগিয়া কেনবা ছাড়হ নাম॥ যৌবন আবেশে সকামের বশে, মজিওনা কামিনী রসে । বঞ্চিত বঞ্চিত ঘোষে।” কে জানিত যে বালক দুষ্ট সঙ্গীবর্গ সহ সারাদিন খেলিয়া বেড়াইত, যে বালক পুঁথির নাম শুনিয়া পলাইত, তাহার মুখ হইতে গভীর জ্ঞানের ধ্বনি উত্থিত হইবে? কে জানিত যে, সেই বালকেই হরিনামে দেশ মাতাইয়া তুলিবে? কাহার দ্বারা কি কৌশলে ভগবান কি কাজ করাইয়া থাকেন, তাহা লোক-বুদ্ধির অগোচর। দেশের জমিদার, ইটার রাজবংশীয় ইস্রাইল খা এই বালক তপস্বীর মহিমা শ্রবণে তৎসহ সাক্ষাৎ করিলেন, তাহার ধৰ্ম্মভাব ও দৈব-শক্তির কথা জ্ঞাত হইয়া তিনি তৎপ্রতি বিশেষ সহানুভূতি প্রদর্শন পূৰ্ব্বক তদীয় তপঃক্ষেত্র পরিস্কৃত করাইয়া দান করিলেন, ইহাই “মোহন্তালয়" (অপভ্রংশ মহলাল) নামে খ্যাত হইল । এইরূপে অঞ্চল হরিনামের ধ্বনিতে পূরিত হইল। একদিন বঞ্চিত কৃষ্ণ প্রেমাবশে নাচিতে নাচিতে ইটার ভাঙার হাটে উপস্থিত হইলেন। জোড়ারাম নামক অত্রত্য এক ব্যবসায়জীবী অতি ধাৰ্ম্মিক ছিলেন, ক্রেতার একটি পয়সাও অতিরিক্ত লইতেন না। তিনি অন্তর্থনামা মহাজন ছিলেন। বঞ্চিত জোড়ারামকে বলিলেন, “সাধো, আমি বহুদিন যাবৎ উপবাসী, তুমি আমাকে দুটি অন্ন খাইতে দাও।” সাধুর অবারিত করুণায় জোড়ারাম কৃতাৰ্থ হইলেন। জোড়ারামের গৃহে আনন্দোৎসব সম্পন্ন হইল, হরিনামের পবিত্র ধ্বনিতে সে স্থান পরিপূরিত হইয়া উঠিল। হরিশ্চন্দ্র নামে এক জাত্যভিমানী ব্যক্তি সৰ্ব্ব জাতির একত্র সমাবেশ ও মিশামিশি দেখিয়া অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া বহুলোক সহ জোড়ারামের গৃহে উপস্থিত হইলেন কিন্তু বঞ্চিতের কাছে আসিলে আর তাহার আক্রোশ থাকিল না; তিনি বুঝিতে পারিলেন, ধাৰ্ম্মিকের কাছে সঙ্কীর্ণতা উপস্থিত হইতে পারে না, ধৰ্ম্ম সামাজিকতার অতীত, সিদ্ধপুরুষ বঞ্চিত সামাজিকতা প্রভৃতি ভেদ বিচারের বহু উৰ্দ্ধ স্তরে আরোহণ করিয়াছেন। বুঝিলেন যে, ভেদ বিচার ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না মনে আত্মপর জ্ঞান রহিত হয়।