পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৪৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৯৮ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ করিয়াছিলেন, তাহাতে লিখিত আছে যে, বেজোড়ার রমানাথ বিশারদ ইহার সহপাঠী ছিলেন।১০৪ উভয়ে একদা গুরুগৃহ হইতে বাড়ী আসিতে ছিলেন, একটা বন্যপথ পার হইবার কালে রমানাথ কিঞ্চিৎ অগ্রে ছিলেন, তিনি হঠাৎ একটা ব্যাঘ্র কর্তৃক আক্রান্ত হন। কিন্তু ব্যাঘ্র তাহার কোন অনিষ্ট করিতে পারে নাই। ইত্যবসরে মহাদেব তথায় আসিয়া পড়িলে, তাহাকে দর্শন মাত্র ব্যাঘ্ৰ চলিয়া যায়। এই ব্যাপার দৃষ্টে রমানাথ মহাদেবকে জিজ্ঞাসা না করিয়া ক্ষান্ত থাকিতে পারলেন না যে কেন তাহাকে দেখিয়াই ব্যাঘ্ৰ মাজ্জারবৎ নিরীহভাবে চলিয়া গেল। উত্তরে মহাদেব বলেন যে, তন্ত্রবিদ্যায় আরও অগ্রসর হইলে তিনি স্বয়ংই ইহা প্রত্যক্ষ করিতে পারিবেন। তাহার পরে মহাদেব ও রমানাথ উভয়ে একত্রে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী সমীপে উপস্থিত হন। সন্ন্যাসী বিশারদকে দেখিয়াই বলিয়া উঠেন—“বৎস, তুমি স্বনামধন্য পুরুষ, কিন্তু তোমার মৃত্যুর আর বিলম্ব নাই।" এই বলিয়া তিনি তাহার মৃত্যুর দিন নির্দেশ করিয়া বলিয়া দিলেন। এতৎশ্রবণে মহাদেব কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধ থাকিয়া বলিলেন—“মহাশয়! ঐ সময় প্রকৃতপক্ষে উহার মৃত্যু ঘটিবেক না, মৃতবৎ হইলেও পরে বাচিয়া উঠিবেন।” সন্ন্যাসী তীব্র দৃষ্টিতে মহাদেবের প্রতি চাহিলেন, মহাদেবের বদনে কি জানি কি দেখিলেন, তাহার মনে কি জানি ভাবতরঙ্গ উঠিল, তিনি চাহিতে চাহিতে মুচ্ছিত হইয়া পড়িলেন। মুচ্ছভঙ্গের পর বিশারদকে বলিলেন—“বৎস, তোমার বন্ধুটিকে সামান্য মনে করিও না, সাক্ষাৎ মহাদেব বলিয়াই জানিও।” মহাদেব ও বিশারদের মধ্যে প্রগাঢ় প্রণয় ছিল, এই প্রণয় চিরদিন অক্ষুশ্নই ছিল; বিশারদের জ্যৈষ্ঠপুত্রের সহিত মহাদেবের দুহিতার পরিণয় সম্পাদিত হওয়ায় উভয় পরিবারের ঘনিষ্টতা বদ্ধিত হইয়া উঠিয়াছিল। মহাদেব সুরাপান মহাপাপ জ্ঞান করিতেন; এমন কি, পূজাদি উপলক্ষে মন্ত্রপূত সুরাপানেও তিনি পক্ষপাতি ছিলেন না। তিনি বলিতেন, সুরাপানে প্রতি সহস্রে একব্যক্তি “কুলকুণ্ডলিনী” জাগাইতে পারে কি না সন্দেহ, কিন্তু ৯৯৯ ব্যক্তিই নিশ্চিত নরকের পথে ধাবিত হয়; এমত স্থলে ইহা সৰ্ব্বথা পরিত্যজ্য । এ সম্বন্ধে বহুতর সুরাপক্ষপাতী পণ্ডিতকে তিনি বিচারে পরাস্ত করিয়াছিলেন। তাহার পৈত্রিক শিষ্য সংখ্যা প্রায় দ্বিসহস্রাধিক ছিল, তিনি সুরাপানের ঘোরতর প্রতিবাদী হওয়াতে ইহাদের প্রভুত কল্যাণ সাধিত হয়। তাহার শাস্ত্রীয় বিচারের প্রণালী অতি সুন্দর ও সরল ছিল, শাস্ত্রার্থ জটিল করিয়া প্রতিবাদীর পরাভব করা অপেক্ষা শাস্ত্রের জটিল স্থলের সরল মীমাংসা করিতেই তাহার অত্যগ্রহ লক্ষিত হইত; তিনি বিনা কারণে পাণ্ডিত্য প্রদর্শনে একান্ত অনিচ্ছুক ছিলেন, সহজে বিচারবিতর্ক বৃত হইতে চাহিতেন না; শেষটা শাস্ত্র বিচারে যাইতেন না ও ভালবাসিতেন না; বিচারবিতর্ক ত্যাগ করিয়া অনুষ্ঠানে নিষ্ঠা প্রদর্শন করিতেন। তিনি কালীভক্ত ছিলেন; শেষকালে গৃহে থাকিয়া কালীভজনা করিয়া সমাধিতে প্রচুর আনন্দ উপভোগ করিতেন। একদিন কালীন্তুতি করিতে করিতে সমাধিস্থ হন, সে সমাধি আর ভাঙ্গে নাই । মহাদেবের জীবনে অনেক অলৌকিক ঘটনা সংঘটিত হইয়াছিল, তদৃষ্টে লোকে তাহাকে দেবাদিদেব মহাদেবের অবতার জ্ঞান করিত। ১০৪. এই প্রবন্ধে বিশারদ সম্বন্ধীয় যে যে কথা লিখিত হইয়াছে, তাহাও উক্ত বিবরণ প্রদাতার প্রেরিত। কিন্তু বিশারদ বংশীয়গণ উহা সৰ্ব্বাংশে স্বীকার করেন না। বিশারদের বিবরণ অতঃপর কথিত হইবে ।