পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবন বৃত্তান্ত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ১০৩ বলিলেন—“এটা কি অপদার্থ" উত্তরে ধূলি-ধূসরিতাঙ্গ নিমাই বলিলেন–“ভাল, ভোজন সময় দেখাইব।” মুরারি আর দৃকপাত না করিয়া চলিয়া গেলেন। মুরারির একথা আর মনে নাই। তিনি আহারে বসিয়াছেন, ভোজন পূর্ণ হইয়াছে প্রায় এমন সময় উলঙ্গ বালক (নিমাই) মুরারির গৃহে উপনীত হইলেন এবং মুরারির থালে প্রস্রাব করিলেন; কি জানি কেন, মুরারি যেন অপ্রতিভ ও কিংকৰ্ত্তব্যবিমূঢ় হইয়া রহিলেন । নিমাই বলিলেন—“মুরারি। হাত মুখ নাড়িয়া বড় জ্ঞানব্যাখ্যা কর দেখি! জগতের প্রাণাধার হরি যে একমাত্র ভক্তিলভ্য, কই-তাহাত বল না?” বালকের মুখে এ কি কথা? শুধু তাহা নহে, বালকের বদনমণ্ডল হইতে যেরূপ প্রভা বিকীর্ণ হইতেছিল, তাহা যেন স্বাভাবিক নহে। মুরারি নিমাইর এই অমানুষী অঙ্গপ্রভা দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। ভোজবাজির ন্যায় কি যে হইল, কি যে দেখিলেন, তিনি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না! নিমাই চলিয়া গেলে, মুরারির চিন্তাভারাক্রান্ত-চিত্তে উদয় হইল যে নিমাই সাধারণ নব-শিশু নহেন। একথাটি মনে উদয় হইবা মাত্র মুরারি জগন্নাথ-গৃহে গিয়া ধূলিধূসরিতাঙ্গ বালককে (নিমাইকে) পুনঃ পুনঃ প্রণাম করিতে লাগিলেন। জগন্নাথ মিশ্র ইহাতে চমকিত হইয়া মুরারির হাতে ধরিয়া বলিতে লাগিলেন—“পুনঃ পুনঃ প্ৰণামের প্রয়োজন কি, ক্ষান্ত হও; এই শিশুকে তোমার ন্যায় প্রাজ্ঞ ও বয়স্ক ব্যক্তি প্রণাম না করিলেও দোষ হইবে না।” মুরারি বলিলেন—“আপনার এই পুত্র কি বস্তু তাহা পশ্চাৎ জানিতে পারিবেন; এ বালকের জনকের ন্যায় ভাগ্যবান আর কে আছে? ইহার পরে যখন নিমাই গঙ্গাদাসের টোলে প্রবিষ্ট হন, তখন মুরারিকে তথায় প্রাপ্ত হইয়া সময় সময় উত্যক্ত করিতে ছাড়িতেন না। মুরারি বিরক্ত হইলেও নিমাইকে কিছু বলিতেন না, তৎপ্রতি তাহার একটা স্বাভাবিক ভালবাসা ছিল । আবার নিমাই যখনই তাহার অঙ্গস্পর্শ করিতেন, তখনই যেন তাহার দেহ দিয়া এক আনন্দ লহরী চলিয়া যাইত। কোনও দিন সেই ভোজনের কীৰ্ত্তিটাও মুরারির মনে হইত, ভাবিতেন নিমাই কি দেববালক! এই যাহা বলা হইল, ইহা স্বয়ং মুরারি লিখিয়া গিয়াছেন। সে যাহা হউক অতঃপর নিমাই যখন পণ্ডিত বলিয়া পরিচিত হইলেন, নিমাই যখন অসাধারণ ভক্তরূপে পরিচিত হইলেন, তখন মুরারি চমকিত হইলেন, তাহার চিত্তে বালকের সেই ভৎসনা বাক্য জাগিল—“জগতের প্রাণাধার হরি যে ভক্তিলভ্য, কই, তাহাত বলনা?” মুরারি পৃথক রহিতে পারিলেন না, আকৃষ্ট হইয়া নিমাইর এক প্রধান ভক্তরূপে পরিণত হইলেন। মুরারি সৰ্ব্বদা নিমাইর সঙ্গে সঙ্গে রহিতেন, নিমাইর প্রত্যেক লীলাতেই তাহারও যোগ ছিল এস্থলে তত্তাবৎ বর্ণনের স্থানাভাব । মুরারি নিমাইর জন্ম হইতে সকল ঘটনাই দেখিয়াছেন এবং তাহার প্রধান প্রধান লীলার অনুষঙ্গী ছিলেন, এই সকল দৃষ্ট ঘটনাবলী অবলম্বনে ১৪৩৫ শকাব্দে তিনি “চৈতন্য চরিত" নামে এক সংস্কৃত গ্রন্থ রচনা করেন; গৌরলীলা সম্বন্ধে ইহাই আদি গ্রন্থ। পরবর্তী কবিগণ এই গ্রন্থ অবলম্বনে শ্রীচৈতন্যচরিত্র বর্ণনা করিয়াছেন। শ্রীচৈতন্য চারিতামৃতকার লিখিয়াছেনঃ– “আদিলীলা মধ্যে প্রভুর যতেক চরিত। সূত্ররূপে মুরারিগুপ্ত করিলা গ্রস্থিত। + + + + তার এই সূত্র দেখিয়া শুনিয়া। বর্ণন করেন বৈষ্ণব ক্রম যে করিয়া৷” ইত্যাদি। শ্রীচৈতন্যমঙ্গল রচয়িতা লোচনদাস লিখিয়াছেনঃ–