পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

৫২ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত তৃতীয় ভাগ-প্রথম খণ্ড শ্রীচৈতন্যের চণ্ডীদান বুরুঙ্গায় কুটুম্ববর্গের প্রীতি বিধান পূৰ্ব্বক যখন শ্ৰীমহাপ্ৰভু তথা হইতে প্রভাতে পিতামহের গৃহে যাইতে ইচ্ছা করিলেন, তৎকালে এক বিধবা ব্রাহ্মণী তাহার সম্মুখবৰ্ত্তিনী হইলেন। বিধবা যুক্ত করে বলিতে লাগিলেন– “হে মিশ্রকুল প্রদীপ আশ্ৰমত্যাগী হইলেও দীন কুটুম্বকে আপনি ত্যাগ করেন না; অবগত হইয়াছি যে আপনি অনাথ শরণ, তাই আপনার কাছে আসিয়াছি। আপনার অন্যতম পিতামহ কীৰ্ত্তিদ মিশ্রের পত্নী, দেবর ফণিবরের প্রতি অযথা অত্যাচার করায় দৈব্যদোষে ফণিশাপে তদ্বংশ মূৰ্খ অভাগিনীর সেই বংশের বধূ, অভাগিনীর একটি পুত্ৰ— সে মূখ। আমার মূখ পুত্রের জীবনোপায় নিৰ্দ্ধারণ করুন, এই প্রার্থনা। আমার এ প্রার্থনা পূর্ণ করিতে হইবে।” বিধবার এই অপকট ব্যবহারে শ্ৰীমহাপ্ৰভু বিগলিত হইলেন এবং তাহাকে তৎক্ষণাৎ একখানা “চণ্ডী" দিয়া বলিলেন– “এই লও একখানা চণ্ডী । ইহার প্রসাদাৎ তোমার পুত্র ধন ও যশোলাভে খ্যাতিমান হইবে, চণ্ডী যশোদাত্রী "৬ ইহার পরই শ্ৰীমহাপ্ৰভু, ঢাকা দক্ষিণ গমন করেন। শ্রীগর্ভ শ্ৰীমহাপ্রভুর করুণালাভে পরমভাগবত রূপে গণ্য ও ভক্তির অধিকারী হন, বলা বাহুল্য। জ্ঞান ও ভক্তিচিন্তামণির অধিকারী শ্রীগর্ভ অচিরেই “চিন্তামণি" উপাধিতে ভূষিত হন। রাঘব বিদ্যানিধির বিবরণ শ্রীগর্ভ চিন্তামণির পুত্রের নাম রাঘব। অধ্যয়নের পর রাঘব, অধ্যাপক হইতে বিদ্যানিধি উপাধি প্রাপ্ত হইয়া দেশে আসিলে সকলে তাহার সুখ্যাতি করিতে লাগিল । শ্রীহট্ট ইহার পূৰ্ব্বাবধিই মোসলমানাধীন হইয়াছিল, শ্রীহট্টের শাসনকর্তৃগণ তখন আমিল নামে খ্যাত ছিলেন। আমিলদের প্রসঙ্গে শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ২য় ভাগের ৩য় ও ৪র্থ অধ্যায়ে লিখিত হইয়াছে। আমিলগণ সচরাচর নবাব নামে কথিত হইতেন। রাঘব দেশের সেই নবাব সহ পরিচিত হইতে ইচ্ছা করিয়া শ্রীহট্টে গমন করিলেন। তৎকালে নবাব দরবারে হিন্দু ও মোসলমান মৌলবী প্রভৃতি বিদ্বান লোক প্রায়শঃ উপস্থিত থাকিতেন, নবাব সভায় উপস্থিত বিদ্যানিধির বিদ্যাবত্তা ও বুদ্ধি প্রাখৰ্য্যে স্বয়ং নবাব ও সভাসদ্বর্গ তুষ্ঠ হইলেন। নবাব তাহাকে বহু পরিমাণ ভূমি ব্ৰহ্মত্র স্বরূপ দিতে চাহিলেন; কিন্তু সম্পত্তি শাসনে জ্ঞানানুশীলনের বাধা জনে বলিয়া রাঘব তৎসমস্ত অঙ্গীকার না করিয়া বুরুঙ্গা ও তৎপার্শ্ববৰ্ত্ত কয়েকটি গ্রাম মাত্র গ্রহণে তৎকালের ব্রাহ্মণবর্গ যে কীদৃশ নির্লোভ ছিলেন, তাহার উদাহরণ প্রদর্শন করিলেন।৭ ৬. এই চণ্ডী শ্ৰীমহাপ্ৰভু কোথায় পাইলেন। চণ্ডী কি সঙ্গে ছিল? “যিনি মুকুন্দের” প্রেমে গৃহের বাহির হন, যিনি সন্ন্যাসী হইয়াও বৈষ্ণব ধর্মের সংস্থাপক, যিনি সৰ্ব্বদা ভাবোন্মত্ত থাকিতেন, তিনি যে একখানা চণ্ডী গ্রন্থ সঙ্গে সঙ্গে রাখিতেন বা সঙ্গে আনিয়াছিলেন, এমন নহে, কথিত আছে যে, এই চণ্ডী তিনি তৎক্ষণাৎ লিখিয়া দিয়াছিলেন। তিনি অলৌকিক ক্ষমতাবলে তৎক্ষণাৎ ইহা লিখিয়াছিলেন, বলা যাইতে পারে বটে, কিন্তু শ্রীচৈতন্যের চণ্ডীদান কতদূর বিশ্বাস্য বলা যায় না, আবার গ্রন্থান্তরে শ্ৰীমহাপ্রভুর প্রথমাগমনকালে বুরুঙ্গায় শ্ৰীমদ্ভাগবত দানের কথা পাওয়া যায়, সে কথার প্রতিধ্বনি উহা কি বা বলা যায় না। ৭. অমাবস্যায় চন্দ্রোদয়: রাঘবের এই ব্ৰহ্মত্র প্রাপ্তির কারণ স্বরূপ এক অলৌকিক ঘটনা শ্রীচৈতন্য রত্নাবলী গ্রন্থে লিখিত আছে; কথিত আছে যে নবাব সভায় কথা প্রসঙ্গে সেদিন কোন তিথি, কেহ জিজ্ঞাসা করিলে “অদ্য পৌণমাসী" বলিয়া হঠাৎ রাঘব উত্তর দেন। প্রকৃত প্রস্তাবে সেদিন অমাবস্যা তিথি ছিল এবং রাঘব ভ্রমতঃ পূর্ণিমা বলিয়া ফেলেন। নবাগত পণ্ডিতের এতাদৃশ উত্তরে সভায হাস্য তরঙ্গ উথিত হয়, কিন্তু বিদ্যানিধি ইহতে উত্তেজিত হইয়া উঠেন এবং সগৰ্ব্বে বলেন-"আদ্য নিশ্চয়ই চন্দ্রোদয় হইবে ।" ব্রাহ্মণের এই অসম্ভব দাম্ভিকতায় নবাব বিরক্ত হইলেন এবং চন্দোদয় না হওয়া পৰ্য্যস্ত তাহাকে আবদ্ধ রাখিলেন।