পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

জীবন বৃত্তান্ত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ১৩৩ ইমামকুলির নৌকা মাছুলিয়া হইতে নোয়াবাদ নামক স্থানে পৌছিল। ঐ স্থানবাসী নয়ান কৈবৰ্ত্তের নবাবী নামী কন্যা অশীতি বৎসরে পদার্পণ করিয়াছিল, কিন্তু তৎকাল পর্য্যন্ত এই পবিত্ৰাত্মা নারীর বিবাহ হয় নাই, সে রামকৃষ্ণকে পুত্রজ্ঞান করিত। রামকৃষ্ণকে কুলি লইয়া যাইতেছেন শুনিয়া সে উচ্চৈঃস্বরে বিলাপ করিতেছিল; এদিকে নৌকা সেইস্থানে আসিয়া আটকিয়া গেল। কুলি তীরে বৃদ্ধাকে বিলাপ করিতে দেখিয়া, রোদনের কারণ জিজ্ঞাসিলে, বৃদ্ধ রামকৃষ্ণকে ছাড়িয়া দিতে প্রার্থনা করিল। কুলি রহস্যভাবেই বলিলেন “বুড়ি, যদি একঢাল টাকা দিতে পারিস তবে তোর বেটাকে ছাড়িয়া দিতে পারি" বৃদ্ধার বাস্তবিক কিছু টাকা ছিল, জাল বুনিয়া সে উহা উপাৰ্জ্জন করিয়াছিল, কিন্তু তাহাতে একখানা ঢাল পুরিয়া যাইবে, তত ছিল না। রামকৃষ্ণের স্নেহবিহবলা বৃদ্ধার কিন্তু এতটা বিচার করিবার শক্তি ছিল না। শিষ্য সনাতনও বৃদ্ধাকে সম্মত হইতে পরামর্শ দিলেন; তদনুসারে বৃদ্ধা তাড়াতাড়ি গৃহে গিয়া টাকার ভাণ্ডটি লইয়া বাহির হইয়া আসিল, বৃদ্ধা আসিতে ক্রস্ততাবশতঃ হাত হইতে পড়িয়া সে মৃতভাণ্ডটি ভাঙ্গিয়া গেল—ঝর ঝর করিয়া টাকা ভূমিতে পড়িল, তখন দেখা গেল টাকার পরিমাণ অল্প নহে, বহুপরিমিত অর্থ ভূতলে স্তুপীকৃত হইয়া পড়িয়াছে। বৃদ্ধ অবাক হইয়া রহিল, কুলি একটালের পরিবৰ্ত্তে বহু ঢাল পরিমিত অর্থ পাইয়া পূৰ্ব্ব স্বীকৃতি মতে রামকৃষ্ণকে ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইলেন। কুলি পূৰ্ব্বেই রামকৃষ্ণের দৈবশক্তির পরিচয় পাইয়াছিলেন, এই কাণ্ডটিও তাহারই ইচ্ছাসঞ্জাত বোধে মনে করিলেন যে সাধুর অনিচ্ছায় তাহাকে আর ক্লেশ দেওয়া সঙ্গত নহে। রামকৃষ্ণ সেই স্থানেই রহিয়া গেলেন; সেই স্থানে রামকৃষ্ণ কৈবৰ্ত্তিনী-তনয় রূপেই পরিচিত ছিলেন। সন্নিকটবৰ্ত্ত বিথঙ্গল নামক জঙ্গলে তখন হরাই ও সুরাই১৩৮ নামে দুই ভীষণ দসু্য বাস করিত বুড়ির টাকার গল্প শুনিয়া তাহারা লোভ সম্বরণ করিতে পারিল না। একরাত্রে বুড়ির বাড়ীতে বড় আশায় আসিয়া উপস্থিত হইল। কিন্তু দুস্যদ্বয়ের দসু্যজীবনের অন্ত হইবার সময় আসিয়াছিল, তাই রামকৃষ্ণকে দেখিয়া তাহাদের চিত্ত পরিবৰ্ত্তিত হইয়া গেল, তাহারা সঙ্কল্পিত ইত্যাদি পাপে সংলিপ্ত না হইয়া, সাধুর চরণে পতিত হইল ও অনুতাপ করিতে লাগিল । দসু্যদ্বয়কে রামকৃষ্ণ আশ্বাস দিলেন, তাহারা তদীয় কৃপাপ্রাপ্তে ভক্তরূপে পরিণত হইল। দসু্যদ্বয় রামকৃষ্ণকে বিথঙ্গলের জঙ্গলে লইয়া যাইতে চাহিল। রামকৃষ্ণ ইতিপূৰ্ব্বে বহুতর কৈবৰ্ত্তকে ভেখ দিয়াছিলেন, তাহাদিগকে লইয়া জলপথে বিথঙ্গল গমন করেন ।১৩৯ মহাত্মা রামকৃষ্ণ গোসাঞি কর্তৃক বিথঙ্গলের প্রসিদ্ধ আখড়া স্থাপিত হয়; এতাদৃশ বৃহৎ আখড়া পূৰ্ব্বাঞ্চলে দ্বিতীয় নাই। রামকৃষ্ণ তীর্থভ্রমণকালে এই বিথঙ্গলের জঙ্গলের ধারে একদা উপবেশন করিয়াছিলেন ও গুরুস্মরণে একটি সঙ্গীত রচনা করিয়া গান করিয়াছিলেন। বিথঙ্গলের শ্যামল-বনসুষমা, বিশালবক্ষঃ প্রবাহিনীর নীলিমার সহিত মিলিয়া এক শান্ত সৌন্দর্য্যের উৎস খুলিয়া ছল, তদর্শনে এই স্থানেই সাধনাশ্রম প্রতিষ্ঠিত করিতে তৎকালে তাহার বাসনা জাত ভক্তের বাসনা কদাপি অপূর্ণ রহে না, বাঞ্ছাকল্পতরু হরিই পূরণ করিয়া থাকেন; তাই এথাকার দসু্যদ্বয় দস্যবৃত্তি ত্যাগ করিয়া শিষ্য হইয়া গেল ও তাঁহাকে এথায় আনয়ন করিল। বিথঙ্গলে থাকিয়া রামকৃষ্ণ জগন্মোহনী-মত বিশেষ উদ্যম সহকারে প্রচার করিতে লাগিলেন।১৪০ তাহাতে তাহার নামে কেহ কেহ এই সম্প্রদায়ের নামও করিয়া থাকেন। বস্তুতঃ ১৩৮ ইহাদের প্রকৃত নাম হরিবংশ ও সুরানন্দ। হরিবংশ সাহাকুলোদ্ভব এবং সুরানন্দ দাস জাতীয় ছিলেন। ইহাদের উভয়ের বংশ আছে এবং বংশধরবর্গের অবস্থাও হীন নহে বলিয়া জানা যায়। ১৩৯. বিথজলে এক ব্যক্তির নিকট একটি “শ্রীঅঙ্গরী" দিয়া রামকৃষ্ণ বলেন যে, “ইহাতে আমার শ্রী রাখিয়া গেলাম।" তৎপর অঙ্গুরীয়কটি তাহার বাড়ীতে নিয়া প্রোথিত হইয়াছিল বলিয়া ঐ স্থানই শেষে “শ্রীমঙ্গল” নামে খ্যাত হয় । (এ শ্রীমঙ্গল বিথঙ্গলেরই নামান্তর)