পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫৪৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১৪৮ শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত চতুর্থ ভাগ নিমাইর পার্ষদভক্তরূপে পরিণত হইলেন। তখন শ্রীবাসের বাড়ীতেই কীৰ্ত্তনের স্থান নির্দিষ্ট হইল, এই স্থানেই সকলে সম্মিলিত হইতেন ও সন্ধ্যার পরে দ্বার দিয়া সংকীৰ্ত্তন করিতেন। শ্রীবাসের বাড়ী প্রাচীর বেষ্টিত ছিল। শ্ৰীবাসাদি নিমাইকে ঈশ্বরাবতার বলিয়া বিশ্বাস করিতেন; কি কি লক্ষণ দর্শনে কোন পরীক্ষার পর তাহাদের মনে এই বিশ্বাস জ্ঞাত হয়; এস্থলে তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই; তাহাদের এ বিশ্বাস অটল ছিল। একদা শ্ৰীবাস-গৃহে কীৰ্ত্তন হইতেছে, শ্রীবাসের এক মাত্র পুত্র মুমূর্ষ অবস্থায় শায়িত, হঠাৎ গৃহে ক্ৰন্দন উঠিল, ব্যাপার কি শ্ৰীবাস তাহা বুঝিলেন, বুঝিয়া কীৰ্ত্তন ছাড়িয়া গৃহে গিয়া সকলকে সাবধান করিয়া বলিলেন, “দেখ, আমার আঙ্গিনায় স্বয়ং ভগবান ভাববশে নৃত্য করিতেছেন, তদবস্থায় শিশুর মৃত্যু হইয়াছে, ইহা তাহার পরম ভাগ্য, আমাদেরও ভাগ্য। যদি চিৎকার করিয়া তোমরা তাহার কীৰ্ত্তনের বাধা জনাও, আমি জাহ্নবীতে প্রবেশ করিব।” স্ত্রীলোকেরা ক্ৰন্দনে ক্ষান্ত হইলেন। শ্রীবাস পুনঃ কীৰ্ত্তনমণ্ডলীতে আসিলেন; এদিকে শ্ৰীগৌরাঙ্গ কি আর স্থির থাকিতে পারেন? যে ব্যক্তির অবস্থা ঈদৃশ শোক দুঃখের অতীত হইয়া গিয়াছে, তৎপতি যে দেবদুর্লভ পুরস্কার প্রযুক্ত হওয়া কৰ্ত্তব্য, শ্রীবাস তাহাই পাইলেন—গৌরনিতাইকে পুত্ররূপে পাইলেন। এক গেল—দুই হইল, নশ্বর গেল—অবিনশ্বর রহিল। কীৰ্ত্তনের তেজ উত্তরোত্তর প্রবদ্ধিত হইল; তখন গুজব উঠিল যে, গৌড়ের মোসলমান বাদশা কীৰ্ত্তন দমনে আসিতেছেন। নিরীহ ভক্তবর্গের কেহ কেহ যথার্থই ভীত হইলেন । একদিকে ভয়, অন্যদিকে অনুরাগ, ভক্তবর্গ বড়ই বিপদে পড়িলেন। যখন অনুরাগেরই জয় হইল,—যখন তাহারা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন, তখন শ্ৰীগৌরাঙ্গ দয়ার্দ্র হইয়া মনের অমূলক আশঙ্কাটাও দূর করিয়া দিলেন। শ্রীবাসের ভ্রাতুস্পপুত্রী নারায়ণী তখন চারি বৎসরের বালিকা, সে সম্মুখে খেলিতেছিল, তাহার প্রতি চাহিয়া একদিন শ্ৰীগৌরাঙ্গ শ্ৰীবাস পণ্ডিতকে বলিলেন—“পণ্ডিত ! গৌড়ের বাদশাহ আসিতেছে শুনিয়া ভীত হইয়াছ; মিথ্যা কথা-বাদশাহ আসিবেন কেন? যদিইবা আসেন, ভয় কি? হরিনামে কি তাহার রুচি জনিতে পারে না? যদি আসেন, নিশ্চয় জানিও, তাহার সঙ্কল্প পরিবৰ্ত্তিত হইবে,—মনের বিদ্বেষবুদ্ধি দূর হইয়া মন নিৰ্ম্মল হইবে, আমার বাক্য মাত্রে তিনি ভক্তিপরিপুত হইবেন । হইবে কি না, উদাহরণ দেখ।” এই বলিয়াই নিমাই সম্মুখে ক্রীড়ারত বালিকাকে বলিলেন “নারায়ণি! তোমার কৃষ্ণপ্রেম হউক।" শ্ৰীগৌরাঙ্গের আদেশের কি মহিয়সী শক্তি, শ্রবণমাত্র চারি বৎসরের বালিকা যন্ত্রচালিতবৎ কৃষ্ণপ্রেমে নৃত্য করিতে লাগিল, তাহার অঙ্গে রোমহর্ষাদি সাত্বিক ভাবোদয় হইতে লাগিল, নেত্র হইতে জলধারা বহিতে লাগিল, ও বালিকা ব্ৰজগোপিকার মত কৃষ্ণবিরহে হাহাকার করিতে লাগিল । শ্ৰীবাসাদি দেখিলেন, নিমাইর বদনমণ্ডল হইতে অপূৰ্ব্ব জ্যোতি বিছুরিত হইতেছে, তাহারা “জয় গেীর ভগবান" বলিয়া জয়ধ্বনি দিয়া উঠিলেন। সেই হইতে তাহাদের মনে আর আশঙ্কার লেশও রহিল না; সেই হইতে শ্ৰীগৌরাঙ্গেরও সময় সময় ভগবানাবেশ হইতে আরম্ভ হইয়াছিল। শ্ৰীগৌরাঙ্গ যখন সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া নীলাচলে চলিয়া যান, তখন হইতে "শ্রীবাসাঙ্গন" পরিত্যক্ত হয়; শ্রীবাস গৌরশুন্য নবদ্বীপে বাস করিতে না পারিয়া, এস্থান ত্যাগ করতঃ কুমারহট্টবাসী হন। সেই স্থানবাসী বৈকুণ্ঠ দাস নামক একটি ব্রাহ্মণ তনয়ের সহিত বাল্যকালেই নারায়ণীর বিবাহ হয়, কিন্তু নারায়ণী বালবিধবা হইয়া পড়েন। স্বামীর মৃত্যু হইলে স্বল্পগর্ভা