পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপসংহার শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ১৫৯ করা গিয়াছে, উড়িষ্যার রাজা প্রতাপ রুদ্র সাৰ্ব্বভেীমের বিদ্যাযশ মহিমা শ্রবণে মোহিত হইয়া বৃত্তিদানে তাহাকে নীলাচলে নিয়া স্থাপন করেন। শ্ৰীক্ষেত্রে সাৰ্ব্বভৌমের কাছে শত শত শিষ্য বেদান্ত অধ্যয়ন করিত, রাজা তাহাকে অত্যন্ত সমাদর করিতেন। নীলাচলে বির্বভৌম একদা জগন্নাথ দর্শনে গিয়াছেন, তিনি দেখিলেন যে স্বর্ণকান্তি একটি যুবক জগন্নাথ দর্শনে আসিলেন। তাহার একাগ্রতা অতুলনীয়, তাহার ঐকান্তিকতা অনন্য সাধারণ। যুবকের নেত্রে জলধারা বহিতেছে, যে অশ্রুবারি অপরিমেয় অদ্ভূত; গণ্ড বাহিয়া, দেহ ভিজিয়া, ভূমি আর্দ্র করিয়া সেই জলধারা জলযন্ত্রের উচ্ছাসের ন্যায় ছুটিয়া চলিল—“চতুর্দিকে ছুটে সব নয়নের জল।" সাৰ্ব্বভৌমের বিস্ময় সীমা অতিক্রম করিল; এদিকে যুবক মূৰ্চ্ছা প্রাপ্ত হইলেন। সাৰ্ব্বভৌম দেখিতে পাইলেন যে যুবকের দেহ ছিন্নকণ্ঠ কপোতের মত কম্পিত হইতেছে; দেখিলেন—লোমাবলী যেন সজারু কন্টকের ন্যায় দাড়াইয়া উঠিল, দেহ বিবর্ণ হইয়া গেল ও পরক্ষণে লোমাবলী মূলে চণাকাকৃতি স্থূল ব্রণরাজি উথিত হইল। এসব ভক্তি-লক্ষণ মানবে কদাচিৎ লক্ষিত হয়, সাৰ্ব্বভৌম ইহা দেখিয়া বিক্ষিত ও যুবকের প্রতি অনুরুক্ত হইয়া পড়িলেন এবং তাহাকে লোকদ্বারা বহন করাইয়া নিজ গৃহে লইয়া গেলেন। সাৰ্ব্বভৌমের গৃহে গিয়া সন্ন্যাসীর জ্ঞান সঞ্চার হইল, তাহার সঙ্গীগণও আসিয়া মিলিলেন। সাৰ্ব্বভৌম তাঁহাদের কাছে সন্ন্যাসীর পূৰ্ব্ব পরিচয় পাইয়া পরম তুষ্ট হইলেন এবং স্নেহবশতঃ তাহাকে বেদান্ত শুনাইতে লাগিলেন। শ্ৰীমহাপ্ৰভু সাতদিন কোনরূপ বাক্যব্যয়ব্যতীত বেদান্ত শুনিলেন । সাতদিনেরও পর সাৰ্ব্বভৌম বলিলেন—“চৈতন্য! তুমি সাতদিন বেদান্ত শুনিলে, ভাল কিছুই বলিলে না, তোমাকে ধীশক্তি সম্পন্ন দেখায়, কিন্তু বুঝিতেছ কি না, তাহার লক্ষণ দেখিতেছি না!" সাৰ্ব্বভৌমের প্রশ্নে শ্ৰীগৌরাঙ্গদেব বলিলেন “ব্যাসসূত্রের অর্থ অতি স্পষ্ট কিন্তু শঙ্করের ভাষ্যরূপ জলদ-জালে তাহা আচ্ছাদিত হওয়াতে আপনার অপূৰ্ব্ব ব্যাখ্যাটি তাৎপৰ্য্য হৃদয়ঙ্গম হইতেছে না।” পণ্ডিত কেশরী সাৰ্ব্বভেীমের ব্যাখ্যায় দোষ প্রদর্শন। সন্ন্যাসী পাগল নাকি? তখন সাৰ্ব্বভৌম এক ধমকানি দিয়া তাহার ব্যাখ্যার দোষ দেখাইয়া দিতে শ্রীচৈতন্যকে বলিলেন। তখন যুবক অতুল বাশ্বিন্ন্যাস প্রকাশ করিয়া, অচিন্তিত-পূৰ্ব্ব গভীরার্থ-বচন-পরম্পরায় শান্ত সাগর মথিত করিয়া বেদান্তের ব্যাখ্যা করিলেন, তাহাতে সাৰ্ব্বভৌমের মস্তক ঘূর্ণিত হইল, বিস্মিত হইয়া তিনি মনে করিলেন—“এ শক্তি মানুষে সম্ভবে না। সাৰ্ব্বভৌম বড়ই ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িলেন। এমন সময় শ্ৰীগৌরাঙ্গ একটি শ্লোক উচ্চারণ করিয়া তাহা ব্যাখ্যা করিতে সাৰ্ব্বভৌমকে বলিলেন, তাহা এই— “আত্মারামাশ্চ মুনয়ো নিগ্রন্থা অপুরুক্রমে। কুৰ্ব্বন্ত্য হৈতুকী ভক্তি মিথ্যভুত গুণোহরি।" বাত্যাবিতাড়িত বিক্ষুব্ধ জলধি বক্ষে ভাসমান ব্যক্তি যেমন সাদরে সাময়িক অবলম্বনকে ধরে, সাৰ্ব্বভৌম শ্লোকটি পাইয়া তেমনি সন্তুষ্ট হইলেন ও নিজ প্রণয়ে গৌরব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত কল্পে অপূৰ্ব্ব প্রতিভাবলে শ্লোকটির নয় প্রকার অর্থ করিলেন। অর্থ করিয়া একটু গৰ্ব্বসহকারে সাৰ্ব্বভৌম শ্ৰীগৌরাঙ্গের অভিমত জানিতে তাহার মুখের দিকে চাহিলেন । শ্ৰীগৌরাঙ্গ একটু হাসিলেন, তারপর বলিলেন “আপনি বৃহস্পতিতুল্য-ব্যাখ্যাও অপূৰ্ব্ব ও অন্যান্য সাধারণ, তবে শ্লোকের আরও অভিপ্রায় আছে।" সাৰ্ব্বভৌমের মুখ পুনঃ মলিন হইল, তৎপর শ্রীচৈতন্যের অভিপ্রায়মত শ্লোকাথ শুনিতে ব্যগ্র হইলেন। শ্রীচৈতন্য তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রণালীতে শ্লোকের অষ্টাদশ প্রকার অর্থ করিলেন।