পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত (উত্তরাংশ) - অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি.pdf/৫৬৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

উপসংহার শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ১৭১ এইবার আর সাৰ্ব্বভৌমের শ্রীচৈতন্যকে মনুষ্য বোধ রহিল না। তিনি আপনার বিদ্যাপরিমান জানেন, স্বীয় ছাত্র নৈয়ায়িক শিরোমণি রঘুনাথের জ্ঞানাস্পদ্ধাও জ্ঞাত আছেন,২৬ কিন্তু একি, আজ যে বিদ্যাবিভবের, অনন্ত জ্ঞান গরিমার সৌষ্ঠবসম্পন্ন চিত্র দেখিলেন, তাহা অসীম অপরিমেয়; তাহা কদাপি মানুষে সম্ভাবিত হইতে পারেনা। সাৰ্ব্বভৌমের মনে একথা থাকিয়া থাকিয়া উথিত হইতে লাগিল, তখন তিনি দ্বীন-নেত্ৰে ভক্তিভরে সম্মুখবত্তী শ্রীচৈতন্যের প্রতি চাহিতেই তাহার মাথা ঘুরিয়ে গেল দেখিলেন সম্মুখে এক বিদ্যুতপ্রভ ঋড়ভুজ মুৰ্ত্তি। ইহা কি সাৰ্ব্বভেীমের চিত্ত বিভ্রম? তিনি দেখিলেন যে, সে মূৰ্ত্তির উদ্ধোথিত শ্যামাভ ভুজন্বয়ে ধনুৰ্ব্বাণ ধূত, মধ্যের নীলদুতি করদ্বয়ে মধুর মুরলী রহিয়াছে; এবং নিমের পীতকান্তি হস্তদ্বয়ে দণ্ডকমণ্ডলু সুশোভিত । রাম, কৃষ্ণ, গৌর তিনে এক-অভেদ। সাৰ্ব্বভৌম যখন প্রকৃতিস্থ হইলেন, তখন সেই গৰ্ব্বিত বৃদ্ধ, যুবকের চরণে, লক্ষণাৎ নিমের শ্লোক উচ্চারণপূৰ্ব্বক দণ্ডবৎ পতিত হইলেন— “কালান্নষ্টং ভক্তিযোগং নিজং যং প্রাবিষ্কর্তুং কৃষ্ণচৈতন্য নামা। আবির্ভুত স্তস্য পদারবিন্দে গাঢ়ং গাঢ়ংলীয়তাং চিত্তভুঙ্গঃ৷” নীলাচলের রাজা প্রতাপরুদ্র সাৰ্ব্বভৌমের মুখে এ সংবাদ শুনিলেন, আর তাহার বর্ণনানুরূপ একটি প্রতিমূৰ্ত্তি শ্রীমন্দিরের পাযাণগাত্রে খুঁদাইয়া রাখলেন, তাহা হইতেই ষড়ভুজ মূৰ্ত্তির নানারূপ ছবি প্রচারিত হইয়াছে। শ্ৰীমহাপ্রভু ১৪৩১ শকের মাঘ মাসে সন্ন্যাস গ্রহণ করিয়া নীলাচলে আসেন, পরবত্তী বৈশাখ মাসেই তিনি দক্ষিণ দেশের তীর্থ সমূহ দর্শন করিতে গমন করেন, এ অপূৰ্ব্ব কাহিনী বর্ণনের একান্ত স্থানাভাব । দক্ষিণের বহু তীর্থ দর্শন ও বহু সহস্ৰ লোককে বৈষ্ণবধৰ্ম্মে দীক্ষিত করিয়া দুই বৎসর পরে পুনঃ নীলাচলে আগমন করেন। শ্ৰীগৌরাঙ্গের পরমভক্ত গদাধর পণ্ডিতের নাম একবার মাত্র বলিয়াছি। গদাধর পণ্ডিত শ্ৰীমহাপ্রভুর সহিত নীলাচলে গিয়াছিলেন, তিনি তদবধি, আর কোথায়ও যান নাই; নীলাচলেই ছিলেন ও সময় সময় সুস্বরে তীমদ্ভাগবত পাঠ করিয়া শুনাইতেন। একদিন স্বচ্ছতোয়া বিস্তৃতবক্ষা নরেন্দ্র-সরসী-তীরে ভক্তগণ সমবেত, শ্রীগৌরাঙ্গ ও নিত্যানন্দ আজ উপস্থিত, গদাধর সীমদ্ভাগবত পাঠ করিতেছেন; গৌর নিতাই এক আসনে দুই ভাই উপবিষ্ট হইয়া শুনিতেছেন, সম্মুখে সাৰ্ব্বভৌম, রামানন্দ, স্বরূপ প্রভৃতি। এমন সময় রাজা প্রতাপরুদ্র একটি চিত্রকর সহ তথায় উপস্থিত হইলেন ও এক সুন্দর চিত্র অঙ্কিত করিয়া নেওয়াইলেন। ইহাই গৌরনিতাইর অবিকল চিত্র ২৭ গদাধর যে শ্ৰীমদ্ভাগবত পুথি পাঠ করিতেন, তাহার অক্ষর ২৬. শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূৰ্ব্বাংশ ২য় ভাঃ ২য় খঃ ৭ম অধ্যায়ে ইহাব বিবরণ দ্রষ্টব্য। ২৭. যে ব্রাহ্মণ শ্ৰীগৌরাঙ্গেব সন্ন্যাস দর্শনে পাগল হইয়া “শ্রীচৈতন্য" নামোচ্চারণ পূৰ্ব্বক ভ্রমণ করতঃ চৈতন্য দাস নামে খ্যাত হন, তাহার পুত্রের নাম শ্রীনিবাস। শ্রীনিবাস শ্রীচৈতন্য দর্শন জন্য নীলাচলে গমন করেন; কিন্তু তাহার চৈতন্য দর্শন ঘটে নাই। তিনি পথে থাকিতেই শ্ৰীগৌরাঙ্গের অন্তৰ্দ্ধান ঘটে। শ্রীনিবাসের আশা পূর্ণ না হওয়ায় নীলাচলে পৌছিয়া তিনি ব্যাকুলিত চিত্তে ধরাবলুষ্ঠিত হইতে থাকেন, অনুচর মুখে শ্রীচৈতন্যবিরহ-কাতর রাজা এই সংবাদ শুনিয়া, তাহাকে শ্ৰীমহাপ্রভুর প্রতিকৃতি দেখাইয়া প্রকৃতিস্থ করেন; চিত্ৰখানা শ্রীনিবাস আপন বুকে ধারণ কবেন । ইহার ভক্তি ও ভাব দর্শনে রাজা আর উহা ফিরাইয়া লন নাই, এবং শ্রীনিবাস তাহা লইয়া দেশে আসেন। ইহা তাহার গৃহেই ছিল এবং তাহার বংশধরগণ অধিকারী হন। মহারাজ নন্দকুমার শ্রীনিবাস বংশের শিষ্য ছিলেন, তিনি গুরু রাধামোহন ঠাকুর হইতে উহা প্রাপ্ত হন। কুঞ্জঘাটার সেই তৈলচিত্র হইতেই এক্ষণে শ্ৰীগৌরাঙ্গের আসল প্রতিকৃতি প্রচারিত হইতেছে। আমাদের শ্রীনিতাইলীলা লহরী গ্রন্থে এই চিত্র সন্নিবেশিত আছে।