পাতা:শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত - উত্তরাংশ.pdf/৫৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

১০৭ জীবন বৃত্তান্ত 0 শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত “এই সিদ্ধান্তের সমর্থক অবান্তর আরও প্রমাণ আছে। শ্রীচৈতন্য ও রঘুনাথ সমপাঠী ছিলেন— উভয়ে সৌহাৰ্দ্দও বিলক্ষণ ছিল এবং ইহারা উভয়েই শ্রীহট্ৰীয় সুতরাং এক সমাজভুক্ত ছিলেন বলিয়াই বোধ হয় তাহাদের মধ্যে এত ঘনিষ্ঠতা ছিল। রঘুনন্দন বোধ হয় ইহাদের বয়ঃকনিষ্ঠ, অতএব অল্পবয়সে শ্রীচৈতন্যদেব সন্ন্যাস গ্রহণপূৰ্ব্বক নবদ্বীপ পরিত্যাগ করাতে তদীয় জীবন চরিতে বঘুনন্দনের কোন উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে না, কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেবের নবদ্বীপ পরিত্যাগের পরে যখন রঘুনাথ মধ্যাহ্নমাৰ্ত্তণ্ডের ন্যায় নবদ্বীপপাকাশে দেদীপ্যমান ছিলেন, তখন রঘুনন্দনকে তদীয় সম্পর্কে আসিতে দেখিতেছি। “নবদ্বীপ মহিমা’ হইতেই তৎসম্বন্ধে একটা গল্প উদ্ধার করিলাম ঃ– “কথিত আছে রঘুনন্দন আপন পুত্রের উপনয়ন স্বমতে প্রদান করিয়াছিলেন। ঐ উপনয়নের পর তাহার পুত্র কোনও কৰ্ম্মোপলক্ষে রঘুনাথ শিরোমণিকে নিমন্ত্রণ করিতে গিয়া প্রথানুসারে তাহাকে নমস্কার করেন। কিন্তু শিরোমণি একটু চিন্তা করিয়া প্রতিনমস্কার করিলেন না। বালক পিতৃসন্নিধানে উপস্থিত হইয়া কহিলেন যে জেঠা মহাশয়কে নমস্কার করিলাম কিন্তু তিনি প্রতি নমস্কার করিলেন না। রঘুনন্দন শুনিয়া দুঃখিত হইলেন। যথাসময়ে শিরোমণি উপস্থিত হইলে রঘুনন্দন তাহাকে প্রতি নমস্কার না করিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। তখন শিরোমণি বলিলেন ভাইহে, আমি বিবেচনা করয়িা দেখিলাম তুমি যে মতে পুত্রের উপনয়ন দিয়াছ, তাহাই যদি শাস্ত্রের প্রকৃত মত হয়, তাহা হইলে তোমার তদনুসারে উপনয়ন না হওয়ায়, তুমি নিজে অব্রাহ্মণ রহিয়াছ। সুতরাং অব্রাহ্মণের সন্তান কোন মতেই ব্রাহ্মণ বলিয়া গণ্য হইতে পারিবেন না। আর যদি তোমরা মত যথার্থ শাস্ত্রসম্মত না হয়, তাহা হইলে তোমার পুত্রও এক্ষণে ব্রাহ্মণ হয় নাই। এইরূপ বিবেচনা করিয়াই আমি তোমার পুত্রকে প্রতিনমস্কার করি নাই। তদবধি রঘুনন্দনের সংস্কারতত্ত্বের উপনয়ন প্রথা অপ্রচলিত হইল। এক্ষণে উপনয়ন প্রাচীন মতেই হইয়া থাকে। এই কাহিনীটি হইতে সূচিত হইবে যে উভয়ের মধ্যে সামাজিক ঘনিষ্ঠতাও ছিল; রঘুনাথ বৈদিক ছিলেন, কিন্তু রঘুনন্দন বন্দ্যঘটীয় ছিলেন, উহাদের মধ্যে সামাজিক ঘনিষ্ঠতাও ছিল; রঘুনাথ বৈদিক ছিলেন, কিন্তু রঘুনন্দন বন্দ্যঘটীয় ছিলেন, উহাদের মধ্যে সামাজিকতার ঘনিষ্ঠভাব অন্যত্র অসম্ভব হইলেও শ্রীহট্টের বলিয়াই সম্ভব, কেননা শ্রীহট্টের বাঢ়ী, বৈদিক, বারেন্দ্র ভেদ কদাপি ছিল না, এখনও নাই। রঘুনাথ-রঘুনন্দন নামেরই বা কি ঘনিষ্ঠতা। যদি তাঁহাদের বংশগত ভিন্নতা না জানিতাম, তবে জেঠা মহাশয়কে, ছেলের পিতার জ্যেষ্ঠ সহোদরই ভাবিতাম প্রতিভায়ও উভয়তঃ কি সাদৃশ্য! একই প্রদেশের দুইজন প্রতিভাবান ব্যক্তি যদি একত্রে ভিন্ন স্থানে যায়, তন্মধ্যে যদি একজন বিষয় বিশেষে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তবে অপরেও বিষয়ান্তরে তাদৃশ প্রতিপত্তি লাভের জন্য ব্যাকুল হয়। ইহা স্বাভাবিক এবং এতন্নিমিত্তও উভয়েই শ্রীহট্টের লোক বলিয়া ধারণা করা অসঙ্গত বোধ হয় না।” “আর একটি কথা এস্থলে উত্থাপিত হইতে পারে। শ্রীহট্টে—অতি অল্পাংশ ভিন্ন, সেও অতি অল্পদিন যাবৎ প্রবৰ্ত্তিত—রঘুনন্দনের স্মৃতি প্রচলিত নহে। ইহা বরং রঘুনন্দনের শ্রীহট্টীয়ত্ত্ব প্রমাণিত করে; কেননা ইংরেজী প্রবাদ বাক্যই ইহার সমর্থক। মহাপুরুষেরা স্বীয় জন্মভূমিতে সম্মান লাভ করেন না। ফলতঃ স্বদেশীয়দের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার রঘুনন্দন যেমন মহত্ব-লাভ করিয়াছিলেন, তেমনই স্বদেশীয়দের হিংসামূলে র্তাহার মত নিজের সমাজে প্রচলিত হয় নাই। নৈয়ায়িক শিরোমণির একটি মাত্র ফক্কিকার চোটে সংস্কার তত্ত্বের উপনয়নটা উড়িয়া গেল—রঘুনন্দনের পরম ভাগ্য যে অন্যান্য বিষয় সেই কুশাগ্ৰ বুদ্ধির তর্কের আবৰ্ত্তে পড়িয়া মারা যায় নাই।”