পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
শকুন্তলা
১২১

স্বাধীন পুরুষের যে-ভাব মনে হয়, এই সকল বিষয়ী লোককে দেখিয়া আমার সেইরূপ মনে হইতেছে।”— একটা যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র লোকের মধ্যে আসিয়াছেন, ঋষিকুমারগণ তাহা সহজেই অনুভব করিতে পারিলেন। পঞ্চম অঙ্কের আরম্ভে কবি নানা প্রকার আভাসের দ্বারা আমাদিগকে এইভাবে প্রস্তুত করিয়া রাখিলেন, যাহাতে শকুন্তলা-প্রত্যাখানব্যাপার অকস্মাৎ অতিমাত্র আঘাত না করে। হংসপদিকার সরল করুণগীত এই ক্রূরকাণ্ডেব ভুমিকা হইয়া রহিল।

 তাহার পরে প্রত্যাখান যখন অকস্মাৎ বজ্রের মতো শকুন্তলার মাথার উপরে ভাঙিয়া পড়িল, তখন তপোবনের দুহিতা বিশ্বস্ত হস্ত হইতে বাণাহত মৃগর মতো বিস্ময়ে ত্রাসে বেদনায় বিহ্বল হইয়া ব্যাকুলনেত্রে চাহিয়া রহিল। তপোবনের পুষ্পরাশির উপর অগ্নি আসিয়া পড়িল। শকুন্তলাকে অন্তরে-বাহিরে ছায়ায়-সৌন্দর্যে আচ্ছন্ন করিয়া যে একটি তপোবন লক্ষ্যে-অলক্ষ্যে বিরাজ করিতেছিল, এই বজ্রাঘাতে তাহা শকুন্তলার চতুর্দিক হইতে চিরদিনের জন্য বিশ্লিষ্ট হইয়া গেল, শকুন্তলা একেবারে অনাবৃত হইয়া পড়িল। কোথায় তাত কণ্ব, কোথায় মাতা গৌতমী, কোথায় অনসূয়া-প্রিয়ংবদা, কোথায় সেই সকল তরুলতা পশুপক্ষীর সহিত স্নেহের সম্বন্ধ, মাধুর্যের যোগ, সেই সুন্দর শান্তি, সেই নির্মল জীবন। এই এক মুহূর্তের প্রলয়াভিঘাতে শকুন্তলার যে কতখানি বিলুপ্ত হইয়া গেল, তাহা দেখিয়া আমরা স্তম্ভিত হইয়া যাই। নাটকের প্রথম চারি অঙ্কে যে-সংগীতধ্বনি উঠিয়াছিল তাহা এক নিমেষেই নিঃশব্দ হইয়া গেল।

 তাহার পরে শকুন্তলার চতুর্দিকে কী গভীর স্তব্ধতা, কী বিরলতা। যে-শকুন্তলা কোমল হৃদয়ের প্রভাবে তাহার চারিদিকের বিশ্ব জুডিয়া সকলকে আপনার করিয়া থাকিত, সে আজ কী একাকিনী। তাহার সেই বৃহৎ শূন্যতাকে শকুন্তলা আপনার একমাত্র মহৎ দুঃখের দ্বারা পূর্ণ