পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মনুষ্য
১৮৩

মত কিম্বা তর্ক আহরণ করিবে এমন ইচ্ছা করি না, আমি চাই মানুষ আমাকে আপনার লোক বলিয়া চিনিয়া লইবে। এই ভ্রমসংকুল সাধের মানবজন্ম ত্যাগ করিয়া একটা মাসিকপত্রের নির্ভুল প্রবন্ধ আকারে জন্মগ্রহণ করিতে আমার প্রবৃত্তি হয় না। আমি দার্শনিক তত্ত্ব নই, আমি ছাপার বই নই, আমি তর্কের সুযুক্তি অথবা কুযুক্তি নই, আমার বন্ধুরা আমার আত্মীয়েরা আমাকে সর্বদা যাহা বলিয়া জানেন, আমি তাহাই।”

 সমীর বলিয়া যাইতে লাগিল, “তরুণ বয়সে সংসারে মানুষ চোখে পড়িত না; মনে হইত, যথার্থ মানুষগুলা উপন্যাস নাটক এবং মহাকাব্যেই আশ্রয় লইয়াছে, সংসারে কেবল একটিমাত্র অবশিষ্ট আছে। এখান দেখিতে পাই লোকালয়ে মানুষ ঢের আছে, কিন্তু ‘ভোলা মন, ও ভোলা মন, মানুষ কেন চিনলি না।’ ভোলা মন, এই সংস্পরের মাঝখানে একবার প্রবেশ করিয়া দেখ্, এই মানবহৃদয়ের ভিড়ের মধ্যে। সভাস্থলে যাহারা কথা কহিতে পারে না সেখানে তাহারা কথা কহিবে, লোকসমাজে যাহারা এক প্রান্তে উপেক্ষিত হয় সেখানে তাহাদের এক নূতন গৌরব প্রকাশিত হইবে— পৃথিবীতে যাহাদিগকে অনাবশ্যক বোধ হয় সেখানে দেখিব, তাহাদেরই সরল প্রেম, অবিশ্রাম সেবা, আত্মবিস্মৃত আত্মবিসর্জনের উপরে পৃথিবী প্রতিষ্ঠিত হইয়া রহিয়াছে। ভীষ্ম দ্রোণ ভীমার্জুন মহাকাব্যের নায়ক, কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কুরুক্ষেত্রের মধ্যে তাঁহাদের আত্মীয়-স্বজাতি আছে, সেই আত্মীয়তা কোন্ নবদ্বৈপায়ন আবিষ্কার করিবে এবং প্রকাশ করিবে।”

 আমি কহিলাম, “না করিলে কী এমন আসে যায়। মানুষ পরস্পরকে না যদি চিনিবে তবে পরস্পরকে এত ভালোবাসে কী করিয়া। একটি যুবক তাহার জন্মস্থান ও আত্মীয়বর্গ হইতে বহুদূরে