পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/১৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
মনুষ্য
১৮৫

করে নাই, তাই বলিয়া সে-মূল্য পৃথিবীতে অনাবিষ্কৃত ছিল না— একটি জীবন আপনাকে তাহার জন্য একান্ত উৎসর্গ করিয়াছিল— কিন্তু খোরাক-পোশাক সমেত লোকটার বেতন ছিল আট টাকা, তাহাও বারোমাস নহে। মহত্ত্ব আপনার জ্যোতিতে আপনি প্রকাশিত হইয়া উঠে, আর আমাদের মতো দীপ্তিহীন ছোটো ছোটো লোকদিগকে বাহিরের প্রেমের আলোকে প্রকাশ করিতে হয়— পিসিমার ভালোবাসা দিয়া দেখিলে আমরা মহা দীপ্যমান হইয়া উঠি। যেখানে অন্ধকারে কাহাকেও দেখা যাইতেছিল না সেখানে প্রেমের আলোক ফেলিলে সহসা দেখা যায়, মানুষে পরিপূর্ণ।”

 স্রোতস্বিনী দয়াস্নিগ্ধ মুখে কহিল, “তোমার ঐ বিদেশী মুহুরির কথা তোমার কাছে পূর্বে শুনিয়াছি। জানি না, উহার কথা শুনিয়া কেন আমাদের চিন্দুস্থানী বেহারা নিহরকে মনে পড়ে। সম্প্রতি দুটি শিশু-সন্তান রাখিয়া তাহার স্ত্রী মরিয়া গিয়াছে। এখনও সে কাজকর্ম করে, দুপুরবেলা বসিয়া পাখা টানে, কিন্তু এমন শুষ্ক শীর্ণ ভগ্ন লক্ষ্মীছাড়ার মতো হইয়া গেছে! তাহাকে যখনই দেখি, কষ্ট হয়— কিন্তু সে-কষ্ট যেন ইহার একলার জন্য নহে— আমি ঠিক বুঝাইতে পারিবনা, কিন্তু মনে হয় যেন সমস্ত মানবের জন্য একটা বেদনা অনুভূত হইতে থাকে।”

 আমি কইলাম, “তাহার কারণ, সমস্ত মানুষই ভালোবাসে এবং বিরহ বিচ্ছেদ মৃত্যুর দ্বারা পীড়িত ও ভিত। তোমার ঐ পাখাওয়ালা ভৃত্যের আনন্দহারা বিষণ্ণ মুখে সমস্ত পৃথিবীবাসী মানুষের বিষাদ অঙ্কিত হইয়া রহিয়াছে।”

 স্রোতস্বিনী কহিল, “কেবল তাহাই নয়। মনে হয়, পৃথিবীতে যত দুঃখ তত দয়া কোথায় আছে। কত দুঃখ, আছে যেখানে মানুষের সান্ত্বনা কোনো কালে প্রবেশও করে না, অথচ কত জায়গা আছে যেখানে ভালোবাসার অনাবশ্যক অতিবৃষ্টি হইয়া যায়। যখন দেখি, আমার ঐ