পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
কৌতুকহাস্য
২০৭

 ব্যোম কহিল, “প্রকৃতির প্রতি অন্যায় অপবাদ আরোপ হইতেছে। সুখে আমরা স্মিতহাস্য হাসি, কৌতুকে আমরা উচ্চহাস্য হাসিয়া উঠি। একটা আন্দোলনজনিত স্থায়ী, অপরটি সংঘর্ষজনিত আকস্মিক।”

 সমীর ব্যোমের কথায় কর্ণপাত না করিয়া কহিল, “আমোদ এবং কৌতুক ঠিক সুখ নহে, বরঞ্চ তাহা নিম্নমাত্রার দুঃখ। স্বল্প পরিমাণে দুঃখ ও পীড়ন আমাদের চেতনার উপর যে আঘাত করে তাহাতে আমাদের সুখ হইতেও পারে। প্রতিদিন নিয়মিত সময়ে বিনা কষ্টে আমরা পাচকের প্রস্তুত অন্ন খাইয়া থাকি, তাহাকে আমরা আমোদ বলি না। কিন্তু যেদিন চড়িভাতি করা যায় সেদিন নিয়ম ভঙ্গ করিয়া, কষ্ট স্বীকার করিয়া, অসময়ে সম্ভবত অখাদ্য আহার করি, তবু তাহাকে বলি আমোদ। আমোদের জন্য আমরা ইচ্ছাপূর্বক যে-পরিমাণে কষ্ট ও অশান্তি জাগ্রত করিয়া তুলি, তাহাতে আমাদের চেতনাশক্তিকে উত্তেজিত করিয়া দেয়। কৌতুকও সেই জাতীয় সুখাবহ দুঃখ। শ্রীকৃষ্ণ সম্বন্ধে আমাদের চিরকাল যেরূপ ধারণা আছে, তাঁহাকে হুকা-হস্তে রাধিকার কুটিরে আনিয়া উপস্থিত করিলে হঠাৎ আমাদের সেই ধারণায় আঘাত করে; সেই আঘাত ঈষৎ পীড়াজক; কিন্তু সেই পীড়ার পরিমাণ এমন নিয়মিত যে, তাহাতে আমাদিগকে যে-পরিমাণে দুঃখ দেয়, আমাদের চেতনাকে অকস্মাৎ চঞ্চল করিয়া তুলিয়া তদপেক্ষা অধিক সুখী করে। এই সীমা ঈষৎ অতিক্রম করিলেই কৌতুক প্রকৃত পীড়ায় পরিণত হইয়া উঠে। যদি যথার্থ ভক্তির কীর্তনের মাঝখানে কোনো রসিকতাবায়ুগ্রস্ত ছোকরা হঠাৎ শ্রীকৃষ্ণের ঐ তাম্রকূটধূম পিপাসুতার গান গাহিত, তবে তাহাতে কৌতুক বোধ হইত না; কারণ আঘাতটা এত গুরুতর হইত যে, তৎক্ষণাৎ তাহা উন্নত মুষ্টি আকার ধারণ করিয়া উক্ত রসিক ব্যক্তির পৃষ্ঠাভিমুখে প্রবল প্রতিঘাতস্বরূপে ধাবিত হইত। অতএব, আমার মতে কৌতুক—চেতনাকে পীড়ন; আমোদও তাই।