পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/২৯৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
য়ুরোপযাত্রী
২৮৯

লিভিংস্টোন অথবা স্টান্‌লির মতো ভৌগোলিক আবিষ্কারক নই; পৃথিবীতে যদি অক্ষয় খ্যাতি উপার্জন করতে চাই তো নিশ্চয় অন্যকোনো দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

 ১২ সেপ্টেম্বর। আমাদের বন্ধুর একটি গুণ আছে, তিনি যতই কল্পনার চর্চা করুন-না কেন, কখনো পথ ভোলেন না। সুতরাং তাঁকেই আমাদের লণ্ডনের পাণ্ডাপদে বরণ করেছি। আমরা যেখানে যাই তাঁকে সঙ্গে টেনে নিয়ে যাই, এবং তিনি যেখানে যান আমরা কিছুতেই তাঁর সঙ্গ ছাড়ি নে। কিন্তু, একটা আশঙ্কা আছে, এরকম অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব এ পৃথিবীতে সকল সময় সমাদৃত হয় না। হায়, এ সংসারে কুসুমে কণ্টক, কলানাথে কলঙ্ক এবং বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ আছে— কিন্তু, ভাগ্যিস্ আছে।

 ৫ অক্টোবর। কিন্তু আমি আর এখানে পেরে উঠছি নে। বলতে লজ্জা বোধ হয়, আমার এখানে ভালো লাগছে না। সেটা গর্বের বিষয় নয়, লজ্জার বিষয়— সেটা আমার স্বভাবের ত্রুটি।

 যখন কৈফিয়ত সন্ধান করি তখন মনে হয় যে, য়ুরোপের যে-ভাবটা আমাদের মনে জাজ্বল্যমান হয়ে উঠেছে, সেটা সেখানকার সাহিত্য প’ড়ে। অতএব সেটা হচ্ছে ‘আইডিয়াল’ য়ুরোপ। অন্তরের মধ্যে প্রবেশ না করলে সেটা প্রত্যক্ষ করবার জো নেই। তিন মাস, ছ মাস কিম্বা ছ বছর এখানে থেকে আমরা য়ুরোপীয় সভ্যতার কেবল হাত-পা-নাড়া দেখতে পাই মাত্র। বড়ো রডো বাড়ি, বড়ো বড়ো কারখানা, নানা আমোদের জায়গা; লোক চলছে ফিরছে, যাচ্ছে আসছে; খুব একটা সমারোহ। সে যতই বিচিত্র, যতই আশ্চর্য হোক-না কেন, তাতে দর্শককে শ্রান্তি দেয়; কেবলমাত্র বিস্ময়ের আনন্দ চিত্তকে পরিপূর্ণ করতে পারে না বরং তাতে মনকে সর্বদা বিক্ষিপ্ত করতে থাকে।

 অবশেষে এই কথা মনে আসে—আচ্ছা ভালো রে বাপু, আমি মেনে নিচ্ছি তুমি মস্ত শহর, মস্ত দেশ, তোমার ক্ষমতা এবং ঐশ্বর্যের সীমা