পাতা:সংকলন - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর.pdf/৩৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
পশ্চিমযাত্রীর ডায়ারি
৩৭৯

সেই উত্তাপ কখন্ আকাশপথ থেকে মাটির আড়ালে চলে যায়; মনে ভাবি, একেবারেই গেল বুঝি। কিছু কাল যায়, একদিন দেখি, মাটির পর্দা ফাঁক করে দিয়ে একটি অঙ্কুর উপরের দিকে কোন্-এক আর-জন্মের চেনা-মুখ খুঁজছে। যে-উত্তাপটা ফেরার হয়েছে ব’লে সেদিন রব উঠল সেই তো মাটির তলার অন্ধকারে সেঁধিয়ে কোন্ ঘুমিয়েপড়া বীজের দরজায় বসে বসে ঘা দিচ্ছিল। এমনি ক’রেই কত অদৃশ্য ইশারার উত্তাপ এক হৃদয়ের থেকে আর এক হৃদয়ের ফাঁকে ফাঁকে কোন্ চোরকোঠায় গিয়ে ঢোকে, সেখানে কার সঙ্গে কী কানাকানি করে জানি নে, তার পরে কিছুদিন বাদে একটি নবীন বাণী পর্দার বাইরে এসে বলে “এসেছি”।

 আমার সহযাত্রী বন্ধু আমার ডায়ারি পড়ে বললেন, “তুমি ধরণীর চিঠি-পড়ায় আর মানুষের চিঠি-পড়ায় মিশিয়ে দিয়ে একটা যেন কী গোল পাকিয়েছ। কালিদাসের মেঘদূতে বিরহী-বিরহিণীর বেদনাটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তোমার এই লেখায় কোন্‌খানে রূপক, কোন্‌খানে সাদা কথা, বোঝা শক্ত হয়ে উঠেছে।”

 আমি বললুম, কালিদাস যে মেঘদূত কাব্য লিখেছেন সেটাও বিশ্বের কথা। নইলে তার এক প্রান্তে নির্বাসিত যক্ষ রামগিরিতে, আর-এক প্রান্তে বিরহিণী কেন অলকাপুরীতে। স্বর্গমর্তের এই বিরহই তো সকল সৃষ্টিতে। এই মন্দাক্রান্তাছন্দেই তো বিশ্বের গান বেজে উঠছে। বিচ্ছেদের ফাঁকের ভিতর দিয়ে অণুপরমাণু নিত্যই যে অদৃশ্য চিঠি চালাচালি করে, সেই চিঠিই সৃষ্টির বাণী। স্ত্রীপুরুষের মাঝখানেও, চোখে চোখেই হোক, কানে কানেই হোক, মনে মনেই হোক, আর কাগজে পত্রেই হোক, যে চিঠি চলে সেও ওই বিশ্বচিঠিরই একটি বিশেষ রূপ।